তপ্ত দুপুরে ঘামঝরা অনুশীলন সবে শেষ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই খেলোয়াড়েরা ঠাঁই নিতে ছুটলেন ড্রেসিংরুমের আরামে কিন্তু হেড কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে আরো বেশ কিছুক্ষণ ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সেন্টার উইকেটে রয়ে গেলেন। তাঁর শিষ্যদের সবারই কমবেশি এই মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু গুরুর যে এই মাঠের সঙ্গে পরিচয় ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ শুরুর মাত্র তিন দিন আগে! ম্যাচ ভেন্যুতে এত বিলম্বে অনুশীলন করা নিয়েও তো কম কথা হয়নি। অবশেষে গতকাল সেখানে টেস্টের আগে অনুশীলনের প্রথম দিন পার করল বাংলাদেশ শিবির। যদিও এই মাঠের সঙ্গে কালই তাঁর প্রথম চেনা-পরিচয়ের ব্যাপারটি কিছুতেই মানতে চাইলেন না হাতুরাসিংহে, ‘এখানে আমি আগেও এসেছি। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে এখানেই কানাডার একটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচ ছিল। আমি তখন কানাডার কোচ ছিলাম।’
পরের চার বছরে হাতুরাসিংহের কোচিং জীবনের মোড়ও যেমন ঘুরে গেছে, তেমনি ফতুল্লা মাঠও তার আদি চেহারা পাল্টে নিয়েছে নতুন রূপ। ২০১১ বিশ্বকাপ পূর্ববর্তী সময়ে এখানে তুমুল বৃষ্টিপাত মানেই ছিল গোড়ালি সমান পানিতে মাঠ ডুবে যাওয়া কিংবা একটু বর্ষণেই ম্যাচ ভেস্তে যাওয়া। ২০১১ বিশ্বকাপের পর ঢালাও সংস্কারে এই ভেন্যুর বদলটা আরো ভালো বর্ণনা করতে পারেন ফতুল্লার কিউরেটর শফিউল আলম বেলাল, ‘ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত হওয়ায় এখন বৃষ্টির পরও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই খেলা শুরু করা যায়। ২০১১ বিশ্বকাপের পর সংস্কারকাজের সময় আগেরগুলো ভেঙে নতুনভাবে উইকেট তৈরি করা হয়েছে। আগে ছিল ১১টি উইকেট আর এখন ৭টি।’
অনেক কিছু বদলালেও এখানকার উইকেটের মূল চরিত্র অবশ্য বদলায়নি। ফতুল্লার উইকেট ব্যাটিং উপযোগিতা ধরে রেখেছে এখনো। পার্থক্য বলতে শুধু এটাই তুলে ধরতে পারলেন বেলাল, ‘আগে এখানকার উইকেটগুলো ছিল দলা (বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে যে উইকেট তৃতীয় দিন থেকে ভাঙতে শুরু করে)। এখন উইকেট যাতে না ভাঙে, সে জন্য কিছুটা ঘাস রাখা হয়।’ তাতে উইকেটের সমান বাউন্সও বজায় থাকে এবং বল খুব ভালো ব্যাটেও আসে। ব্যাটিং দিয়ে ভারতের সঙ্গে টেস্টে সমানে-সমান পাল্লা দেওয়ার যে চিন্তা বাংলাদেশ শিবিরের, তার সঙ্গেও ফতুল্লার এখনকার উইকেট খুব যায়। কাকতালীয়ভাবে ৯ বছর আগে এখানে হওয়া একমাত্র টেস্টেও বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের একই রকম চাহিদা ছিল। সেই সময়েও কিউরেটরের দায়িত্বে থাকা বেলালের তা স্পষ্টই মনে আছে।
২০০৬ সালের এপ্রিলে হওয়া সেই টেস্টের জন্য ঘূর্ণিছক কেটে উল্টো নিজেরাই সেই ফাঁদে আটকাতে চায়নি বাংলাদেশ। কারণ অস্ট্রেলিয়া দলে কিংবদন্তির শেন ওয়ার্ন এবং স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের মতো লেগস্পিনারদের উপস্থিতি। এবারো ভারতের ব্যাটসম্যানরা স্পিন খেলায় দক্ষ বলে এবং সেই সঙ্গে রবিচন্দ্রন অশ্বিন-হরভজন সিংয়ের মতো অফস্পিনারদের কারণে সেই পুরনো ছকেই আস্থা বাংলাদেশ শিবিরের। বেলাল অবশ্য এবারের চাহিদা নিয়ে মুখই খুলছেন না। তবু চাদিহাপত্র মেনে টেস্টের জন্য নির্ধারিত ফতুল্লার উইকেটের সজ্জা থেমে নেই। কাল দুপুরে চট দিয়ে ঢেকে রাখা সেই উইকেটটা ‘ফ্ল্যাট’ রাখার নির্দেশনাই বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।
টেস্টের আগে কাল অন্য সেন্টার উইকেটে অনুশীলন পর্বটাও ব্যাটসম্যানরা খুব উপভোগ করেছেন বলে মনে হলো ম্যানেজার খালেদ মাহমুদের কথায়, ‘দারুণ উইকেট। বল খুব ভালো ব্যাটে আসছিল।’ প্রাইম ব্যাংকের কোচ হওয়ায় ঢাকার প্রিমিয়ার লিগ এবং বিসিএলের সময় যাঁর নিয়মিতই পদধূলি পড়ে ফতুল্লায়। ৯ বছর পর আরেকটি টেস্ট ম্যাচ সামনে রেখে যেখানকার শান্ত ও নিস্তরঙ্গ চেহারাটা দু-এক দিনের মধ্যেই বদলে গিয়ে মাহমুদের ভাষায় ‘বিয়ে বাড়ি’র সাজ নেওয়ার কথা। এসব উপলক্ষে সাধারণত সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও হয়ে থাকে। কিন্তু মূল ফটক থেকে স্টেডিয়ামের ভেতরে যাওয়ার লম্বা পথের দুই ধারের গাছ কেটে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ উল্টো সৌন্দর্যহানি কেন করল, সেই রহস্য কারো কাছেই ঠিক পরিষ্কার নয়। তবে এসবও শেষ পর্যন্ত কারো চোখে খুব বেশি পড়বে না, যদি টেস্টে বাংলাদেশের পারফরমেন্সটা ভালো হয়। ফতুল্লায় বিভিন্ন পর্যায়ের আসর মিলিয়ে গত এক বছরে শতাধিক ম্যাচ হয়েছে, কিন্তু এই মাঠ নিয়ে এত আলোচনা-গবেষণার ব্যস্ততা তো টেস্ট হচ্ছে বলেই। তো সেখানে ভারতের মতো প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিজ দলের ভালো করার বিষয়ে কতটা আস্থাশীল হাতুরাসিংহে? এই লঙ্কান অবশ্য প্রশ্নের জবাবে শিষ্যদের তাতাতেই চাইলেন। একই সঙ্গে কিঞ্চিৎ রসিকতা করার সুযোগও ছাড়লেন না, ‘ভারতের বিপক্ষে খেলছে বলেই নয়, দেশের হয়ে খেলাটাই এক বিরাট অনুপ্রেরণা। সেটা যদি না থাকে, তাহলে বাস চালানো ভালো!’
বাসের কথা বললেন কারণ অনুশীলন শেষে অপেক্ষমাণ টিম বাসও তখন দল নিয়ে ঢাকায় ফেরার অপেক্ষায়। হাতুরাসিংহে অবশ্য পুরো বাংলাদেশকে অন্য এক অপেক্ষায়ও রেখে দিলেন। যদি এ ফতুল্লা থেকেই ধরা দেয় টেস্টের সুদিন, যদি ভারতকেও চমকে দিতে পারে বাংলাদেশ!