যাত্রাপথ রাজধানীর হাতিরপুল ইস্টার্ন প্লাজার সামনে থেকে বনানী। সিএনজি চালিত অটোরিকশা খুঁজছিলাম। ফাঁকা সিএনজির অভাব নেই। তবে চালকদের কেউই মিটারে যেতে রাজি হলেন না। মনে হচ্ছিল তারা যেন জোটবদ্ধ। যেন পূর্বপরিকল্পনা মাফিক ভাড়া হাঁকাচ্ছেন ৩০০-৩৫০ টাকা।
মিটার আছে কিনা জানতে চাইলে এক সিএনজি চালক কিরন বলেন, ‘মিটার আছে কিন্তু মিটারে যাব না।’ কারণ জানতে চাইলে ঐ চালক বলেন, ‘দৈনিক জমা দিতে হয় ১ হাজার টাকা। মিটারে গেলে জমা আর গ্যাস খরচ ওঠানো যাবে না।’ আমরা বউ-পোলাপাইন নিয়ে খাব কীভাবে; প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ওই সিএনজির ভেতরে দেয়া মালিক বিপুলের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করলে ফোন ধরেন তার ভাতিজা দেবাশিস। প্রতিদিন জমা ১ হাজার টাকা নেয়ার কারণ জানতে চাইলে দেবাশিস তা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আমরা ১ হাজার টাকা নিচ্ছি না। আমরা দৈনিক সাড়ে ৮ শত টাকা করে নিচ্ছি।’ সেটাও তো সরকার নির্ধারিত জমার চেয়ে বেশি। প্রতিবেদকের এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘১৭ শত টাকার টায়ারের দাম এখন ২৭ শত টাকা। আগে চায়নার পার্টস সস্তায় পাওয়া যেত। এখন ইন্ডিয়ার পার্টস বেশি দামে কিনে লাগাতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ১২০০ টাকার চাক্কা এখন ৩০০০ টাকা, কাগজ করতে আগে লাগতো ৪০০০ হাজার টাকা আর এখন লাগে ১১ হাজার টাকা। ‘আগে সাড়ে চার লাখ টাকা হলেই ঢাকার নাম্বারসহ সিএনজি পাওয়া যেত এখন লাগে ১৪ লাখ টাকা।’ সব মিলিয়ে তাদের বেশি লাভ থাকে না উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়া ঈদ বোনাস ৭ শত টাকা, অর্ধেক দিনের জমা ৫০০ টাকা ও মে দিবসে ফ্রি চালাতে দেয়াসহ অন্য আরও অনেক সুবিধা ড্রাইভারদেরকে দিতে হয় বলেও দাবি করেন তিনি।
বিআরটিএ সুত্রে জানা গেছে, সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢাকায় চলাচলকারী সিএনজিগুলো প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ২৫ টাকা ও পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ৭ টাকা এবং যানজট বা যাত্রা বিরতিতে অপেক্ষার জন্য এক টাকা ২৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। নির্দেশনা দেয়া হয় সিএনজি চালকরা প্রতিদিন ৬০০ টাকা করে মালিকদের জমা দিবে বলে।
আলাপ হচ্ছিলো পান্থপথ মোড়ে থেমে থাকা এক সিএনজির চালক আব্দুর রহিমের সাথে। মিটারে না গেলে পুলিশ কোনো সমস্যা করে কিনা জানতে চাইলে আব্দুর রহিম বলেন, ‘ধরা খেলে পুলিশ তো সমস্যা করেই। মামলা করে আবার রেকারিং করবে বলে ২-৩ হাজার টাকা জরিমানা করে।’ তবে এ ধরণের ঘটনায় বেশি পরতে হয় না বলেও জানান তিনি। কারণ গুলশান, বনানীসহ যেসব এলাকায় পুলিশ চেকপোস্ট বেশি সেসব এলাকায় সহজে যেতে চান না। যদিওবা কখনও ওইসব এলাকায় যান, তখন তারা মিটারেই ভাড়া নেন বলে জানান তিনি।
মিটারে না গেলে যাত্রীরা কেমন ব্যবহার করে জানতে চাইলে রহিম বলেন, ‘যাত্রীরা এখন বোঝে আমাদের জমা বেশি দিতে হয়। ২-৩ বছর আগে মিটারে না গেলে ঝগড়া করতো। এখন সরাসরি ভাড়া কত জিজ্ঞাসা করে। পোষালে যায়।’ যাত্রী হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে রহিম আরও বলেন, ‘গতকাল এক পুলিশ অফিসারকে পরিবাগ থেকে গুলশানে নিয়ে গেছি। সেও মিটারের কথা কিছু বলে নাই। জিজ্ঞাসা করছে ভাড়া কত। আমি বলছি, ১২০-১৩০ টাকা যা দিয়ে সবসময় যান দিয়েন। পরে তিনি আমাকে ১৪০ টাকা দেন।’
চালক রহিমের সাথে কথা বলা অবস্থায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন মতিঝিল যাবেন কিনা। রহিম যাব উত্তর করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কত? রহিম ১৫০ টাকা ভাড়া চায়। একপর্যায়ে উভয়পক্ষ ১৩০ টাকায় সম্মত হন। মিটারে যেতে চাইলেন না কেন; এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওদেরকে মিটারের কথা বলে লাভ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ মিটারে যেতে রাজি হবে না। শুধু সময় নষ্ট।’ ঠিক সময়ে অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকে তাদের, স্মরণ করে দিতে ভোলেন না ওই যাত্রী।
শেরাটন হোটেল মোড়ে সিগন্যালে আটকে থাকা এক সিএনজির যাত্রী রোকসানা ইয়াসমিন বলেন, ‘সায়দাবাদ থেকে আসছি মিরপুরে যাব।’ মিটারে যাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কে? পুলিশ না তো? সাংবাদিক পরিচয় দিলে রোকসানা বলেন, ‘পুলিশে ধরলে মিটারে বলতে হতো।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিএনজিওয়ালা ওঠার আগে বলে দিছে।’ তাছাড়া পুলিশ সিএনজি আটকে দিলে তাকে মিরপুরে যেতে ঝামেলায় পরতে হবে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ট্র্যাফিক রমনা জোনের সার্জেন্ট জাহিদুল ইসলাম এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, তারা প্রতিনিয়ত সিএনজি চেক করেন। যাত্রীরা অভিযোগ দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেন। ‘মিটারে না গেলে ঐ সিএনজি চালকের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করি। তবে অফিস টাইমে খুব একটা চেক করার সুযোগ থাকে না। তখন গাড়ির লোড বেশি থাকে। ফলে গাড়ি থামিয়ে চেক করতে গেলে বড় যানজট তৈরি হয়ে যায়। চালকরাও দেখা যায় রাস্তার মাঝামাঝি দিয়ে চালিয়ে চলে যায়।’ দাবি করেন তিনি।
একইভাবে ট্রাফিক পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক বিভাগ, উত্তর) মো. আবু ইউসুফ দাবি করেন, ‘মিটারে চলে না এমন সিএনজি চালকদের বিরুদ্ধে মামলা দেই। আদালতে তার একটি প্রতিবেদন পাঠাই। আদালতে বিচার করে ঐ চালকের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়।’