৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই থই থই পানিতে ভেসেছে রাজধানী। দেড় ঘণ্টার বর্ষণে তলিয়ে যায় রাজধানীর অধিকাংশ সড়ক। হঠাৎ এমন জলজটে থমকে দাঁড়ায় রাজধানীর জনজীবন। দুপুর থেকে জলজটের সঙ্গে যোগ হয় অসহনীয় যানজট। কোন কোন সড়কে কোমর সমান পানি জমায় যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়। যানজট আর জলজটের এ দুর্ভোগ চলে দিনভর। এদিকে শুধু রাজধানীই নয়, চট্টগ্রাম এবং সিলেট নগরীতেও গতকাল দিনভর জলাবদ্ধতা দেখা যায়। সকাল থেকে ভারি বর্ষণ হওয়ায় ওই দুই নগরীতেও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। গতকাল বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে নগরীতে এমন নজিরবিহীন পরিস্থিতি দেখা দেয়। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে রাজধানীবাসীকে বর্ষা মওসুমে প্রায়শই এ ধরনের দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। এক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন অনেকেই। দায়ী করেন অবৈধ দখলদারদেরও। কারণ অবৈধ দখলদারের কারণে নগরীর পানি নিষ্কাশনের ১৭টি খাল অস্তিত্বহীন। ৬৩টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও পানির ধারণ ক্ষমতা তেমন নেই সেগুলোর। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে নেমে আসে দুর্ভোগ।
আবহাওয়া অফিস জানায়, মওসুমি বায়ুর প্রভাবে গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা প্রবল বেগে চলে বৃষ্টিপাত। তবে বেলা ১টা পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকলেও গতিবেগ ছিল কম। দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকা গুলশান বনানী, ধানমন্ডিসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, অলি-গলিতে পানি জমে যায়। এ সময় বিভিন্ন সড়কে বিকল হয়ে পড়ে যানবাহন। এতে প্রায় প্রতিটি সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। এ সময় যানবাহনে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়েছে নগরবাসীকে। শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃষ্টি কমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বৃষ্টি কমার পর একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠেন তিনি। পার্থ বলেন, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট যেতে তার সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টারও বেশি। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে সড়কে থই থই পানির কারণে অটোরিকশা থেকে নেমে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর মধ্যে বিমানবন্দর সড়কের বনানী অংশ এবং মতিঝিল, ফার্মগেট, পল্টন, শাহবাগ, মৌচাক মালিবাগ, মগবাজার, শান্তিনগর কাকরাইল এলাকায় যানজট ছিল বেশি। এসব সড়কের বেশির ভাগ অংশই পানিতে তলিয়ে যায়। এ ছাড়া ফার্মগেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়কের বিভিন্ন অংশও পানিতে ডুবে যায়। ফলে যান চলাচলের গতি কমে যায়। এ সময় বিজয় সরণি ও কাওরানবাজার সিগন্যালে গাড়ির চাপ ছিল বেশি। রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে পানি জমে যাওয়ায় সেখানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। মিরপুর রোড, সাতরাস্তা সড়কেও দেখা দেয় তীব্র যানজট। এ ছাড়া রামপুরা থেকে কাকরাইল মোড়, মৌচাক থেকে মগবাজার পর্যন্ত সড়কগুলোতে যানবাহন চলেছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। এসব সড়কে ভ্যান, রিকশা গর্তে পড়ে দুর্ঘটনায় পড়তে দেখা গেছে। মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, পান্থপথ, গ্রিনরোডসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে যানবাহন থমকে ছিল। অ্যাম্বুলেন্সগুলোকেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যানজট মোকাবিলায় ট্রাফিক পুলিশ ছিল অনেকটা অসহায়। এ সময় অনেক এলাকায় উল্টো পথে গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছে তারা। কাওরান বাজার থেকে মহাখালী পর্যন্ত যেতে চার ঘণ্টা সময় লাগার কথা জানিয়েছেন আবু হানিফ নামের এক যাত্রী। তিনি জানান, জরুরি কাজে গাড়িতে করে ওই এলাকায় গেলেও পরে তিনি হেঁটে মোহাম্মদপুর ফিরেন যানজটের কারণে।
এদিকে যানজট আর জলজটের কারণে গতকাল রাজধানীতে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা ও ভ্যান চালকদের কাছে জিম্মি ছিলেন সাধারণ যাত্রীরা। বারডেম হাসপাতাল থেকে নিউ ইস্কাটনে একটি সিএনজি অটোরিকশায় করে আসা যাত্রী ফাহমিদা জানান, ওই দূরত্বে যেখানে ৫০ থেকে ৬০ টাকা ভাড়া সেখানে তাকে আড়াইশ টাকা দিতে হয়েছে। বৃষ্টির কারণে দীর্ঘ সময় আটকা থেকে বাধ্য হয়েই ওই ভাড়ায় তিনি আসেন। মগবাজার থেকে শান্তিনগর যেতে ১০০ টাকা রিকশা ভাড়া দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন যাত্রী নুরুন্নবী। তিনি জানান, মগবাজারে একটি স্কুলে তার মেয়ে সকালে ক্লাস করতে যায়। দুপুরে তাকে আনতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। ওই সড়কে পানি জমায় কোন যানবাহন পাননি। ফলে বাধ্য হয়ে ১০০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে যেতে হয়। সোনারগাঁও হোটেলের পাশের সড়কে কোমর সমান পানি জমায় ওই সড়কে রিকশা এবং ভ্যান দিয়ে রাস্তা পার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। মাহিন নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, ৩০টাকা দিয়ে ভ্যানে করে ওই এলাকার সড়ক পার হতে হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ডিউটি সহকারী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, মওসুমি বায়ুর প্রভাবে মঙ্গলবার রাত থেকে বর্ষণ শুরু হয়। দিনে তার মাত্রা বাড়ে। এতে ডুবে যায় রাজধানী ঢাকা,বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা। গতকাল টেকনাফে ১১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ওদিকে শরতের আকস্মিক এই বর্ষণের কারণে গতকাল রাজধানীতে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী এবং অফিসগামী কর্মজীবীদের সীমাহীন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। সেই সঙ্গে জ্যামে স্থবির হয়ে পড়েছে ঢাকা মহানগরী। উত্তর বঙ্গোপসাগরে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হওয়ায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থার এক সতর্ক বার্তায় বলা হয়, গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার হতে পারে। তবে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া বিভাগ। অপরদিকে সকাল নয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে।
জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে সঠিক পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, কারণ চিহ্নিত। জলাবদ্ধতার এই সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। মূল কারণ হচ্ছে উন্মুক্ত জায়গা কমে যাওয়া। স্বাধীনতার আগে ধোলাইখাল ভরাট হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে এগুলো আরও বেড়েছে। ঢাকার খালগুলো নানাভাবে ভরাট হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলোর প্রবাহ কম। রাস্তা তৈরির সময় যে কালভার্টগুলো তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোর কার্যকারিতা কমে গেছে। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। অনেক এলাকায় ড্রেন ও নদীর সংযোগ মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। ওইসব এলাকা দিয়ে পানি সহজে নামতে পারে না। স্লুইস গেট দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সেই গেটগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। পাম্পিং হাউসগুলো ঠিকমত কাজ করছে না। অন্যদিকে আবাসন প্রকল্পের কারণে পুকুর, খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এসব কারণে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।