ক্ষণে ক্ষণে উলুধ্বনি, শঙ্খ, কাঁসর আর ঢাকের বাদ্যি জানান দিচ্ছে ঠাকুরঘরে উদ্ভাসিত মৃন্ময়ী রূপিণী প্রতিমা বরণ। চিন্ময়ী আনন্দরূপিণীর বোধন হয়েছে গতকাল। শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাণের উত্সব শারদীয় দুর্গোত্সব। আজ সোমবার মহাষষ্ঠী। রাত ৯-৫৭ মিনিট অবধি তিথি থাকবে। আগামীকাল মহাসপ্তমী। মহাসপ্তমীর প্রভাতে ঢাক-ঢোলক-কাঁসর বাজিয়ে কলাবউ স্নান ও আদরিণী উমার সপরিবারে তিথি বিহিত পূজা। মহাসপ্তমীতে ষোড়শ উপচারে দেবীর পূজা হবে। সকালে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে। দেবীকে আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, স্নানীয়, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে পূজা করবেন ভক্তরা। সপ্তমী পূজা উপলক্ষে সন্ধ্যায় পূজামণ্ডপে ভক্তিমূলক গান, রামায়ণ পালা, আরতিসহ নানা অনুষ্ঠান হবে। ২১ অক্টোবর মহাঅষ্টমীর দিন সকালে কুমারী পূজা ও রাতে সন্ধিপূজা, কালীপূজা। ২২ অক্টোবর মহানবমী এবং বিজয়া দশমী। তিথির কারণে কিছুটা তারতম্য এসেছে এবারের পূজার নির্ঘণ্টে। এবার একই দিনে নবমী ও দশমী পূজা হলেও শুক্রবার ২৩ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জন ও বিজয়া শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ দল বেঁধে পূজা দেখতে আসছে। বিকাল থেকেই পূজামণ্ডপগুলোয় দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। বাহারি পোশাকে সাজিয়ে রাঙিয়ে উত্সব-আনন্দে মেতে উঠেছে শিশু-কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। গতকাল সন্ধ্যায়ই রাজধানীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঝলমলে আলোকসজ্জায় রঙিন হয়ে ওঠে। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মোড় থেকে মন্দির প্রাঙ্গণের দিকে এগিয়ে যেতে চোখে পড়ছে লাল-নীল আলোর চোখ ধাঁধানো খেলা। মন্দিরের প্রবেশ তোরণ থেকে মন্দিরজুড়েই বর্ণিল আলোকের রূপবিন্যাস। এ চিত্র কেবল ঢাকেশ্বরী নয়, দেশের প্রায় সব মন্দির ও পূজামণ্ডপের। এ বছর সারাদেশে ২৯ হাজার ৪০০ মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজধানীতে বসেছে ২২২টি মণ্ডপ। আলাদা তাজিয়া মিছিল ও প্রতিমা বিসর্জন দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জন ও পবিত্র আশুরায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল একই দিনে হওয়ায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে মহানগর পুলিশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা শেষ করতে বলেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এ কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, আগামী ২৩ অক্টোবর শুক্রবার দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন ও তাজিয়া মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। পুলিশের বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জন দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে করতে হবে। এরপর সন্ধ্যা ৭টা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত তাজিয়া মিছিল হবে। তিনি বলেন, ঢাকার দুটি স্থানে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো পুরান ঢাকার ওয়াইজ ঘাট ও উত্তরার বিআইডব্লিউটিএ’র ল্যান্ডিং স্টেশন। এর মধ্যে যারা ওয়াইজ ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দেবেন তাদের সকাল ১০ থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে জড়ো হতে হবে। জুমার নামাজ থাকায় বেলা ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জনের আনুষ্ঠানিকতা করা যাবে না। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণী প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, শারদীয় দুর্গোত্সব উপলক্ষে আমি বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সারাদেশে যথাযথ উত্সাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় গাম্ভীর্য এবং অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা উদ্যাপিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। সমাজে অন্যায়, অবিচার, অশুভ ও অসুরশক্তি দমনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ পূজা হয়ে থাকে। সব ধর্মের মূলবাণী মানবকল্যাণ। দুর্গোত্সব সত্য-সুন্দরের আলোকে আলোকময় হয়ে উঠুক। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং ধর্মের মূলবাণী আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে উদ্বুদ্ধ করুক। বিশ্বমানবতার জয় হোক – এ কামনা করি। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল ধরে এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি অত্যন্ত জাঁকজমক ও শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণীতে বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে আমি দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকল নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দুর্গোত্সবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। আমার প্রত্যাশা, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব।