ফুটবল ইতিহাস নতুন করে লেখালেন লিওলেন মেসি। পেলে-ম্যারাডোনা-ইয়োহান ক্রুইফ যুগের পর ফুটবল বিশ্ব মাতান ব্রাজিলের রোনালদো, রোনালদিনহো, লুইস ফিগো, ডেভিড বেকহ্যাম ও কাকারা। কিন্তু লিওনেল মেসি যে কীর্তি গড়লেন তা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। পঞ্চমবারের মতো ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার ব্যালন ডি’অর জিতে নিলেন তিনি। এতে দুই বছর পর ফের রাজ্য ফিরে পেলেন বার্সেলোনার এ আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার। ২০০৯ থেকে ২০১২, টানা চারবার তিনি এই পুরস্কার জেতেন। কিন্তু এরপর তার প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদোর কাছে রাজ্যহারা হন। ২০১৩ ও ২০১৪, টানা দুই বছর এ পুরস্কার জিতে নেন রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগিজ উইঙ্গার। কিন্তু এবার নিজের পঞ্চম পুরস্কার জিততে মোটেও বেগ পেতে হলো না লিওনেল মেসিকে। ২৮ বছর বয়সী বার্সেলোনার এ আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার ৪১.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আর তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদো পেয়েছেন ২৭.৭৬ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো সেরা তিনে জায়গা পাওয়া বার্সেলোনার ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার নেইমার পেয়েছেন ৭.৮৬ শতাংশ ভোট। গত বছর ৬১ ম্যাচে ৫২ গোল ও ২৬ গোলে সহায়তা করে বার্সেলোনাকে পাঁচ শিরোপা জিতিয়েছেন মেসি। ২০১৫ সালে তিনি গড়ে ১০১ মিনিটে এক গোল ও ২০২ মিনিটে একবার সহায়তা করেছেন মেসি। মেসির চেয়ে বেশি, ৫৭ গোল করেও গত মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদকে কোনো শিরোপা জেতাতে পারেননি রোনালদো। এতে ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার পুরস্কার জেতায় মেসি ৫ ও রোনালদো ৩।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার কে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত বিতর্কের শেষ নেই। দুই কিংবদন্তি পেলে ও দিয়েগো ম্যারাডোনাকেই নিয়ে এক সময় এ বিতর্ক আবর্তিত হতো। কিন্তু তারপর যোগ হয় মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নাম। তবে মেসি ক্রমান্বয়ে নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদোকে বাদ দিয়ে তার লড়াই এখন পেলে-ম্যারডোনার সঙ্গে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বকাপ জেতা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে পেলে-ম্যারাডোনার চেয়ে এগিয়ে মেসি। মেসির বয়স সবে ২৮। এখনও বেশ কয়েক বছর স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে যেতে পারবেন। সম্ভাবনা আছে আরও ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জেতার। কিন্তু আর যদি নাও জিততে পারনে তাহলেও তার গড়া এই রেকর্ড স্পর্শ করা কারও জন্য বেশ কঠিন হবে। বার্সেলোনায় যোগ দেয়ার এক যুগের মধ্যে তিনি ক্লাবটির সর্বকালের সর্বাধিক গোলের রেকর্ড গড়েছেন। স্প্যানিশ লা-লিগার ইতিহাসে গোলে তিনি সবার ওপরে। শুধু গোল নয়, সহায়তায়ও তিনি লা-লিগায় সবার ওপরে। লা-লিগায় এক মৌসুমে (২০১১-১২) সর্বোচ্চ ৫০ গোলের (৩৮ ম্যাচ) রেকর্ডটিও এখন তার। ওই মৌসুমে সব মিলিয়ে তার সর্বোচ্চ ৭৩ গোলের রেকর্ডটাও এখন পর্যন্ত অক্ষুণ্ন। স্পেনের এল-ক্লাসিকো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবলযুদ্ধ। এ যুদ্ধে দুই হ্যাটট্রিক করা একমাত্র খেলোয়াড় মেসি। এছাড়া রিয়ালের বিপক্ষে তার ২১ গোলও সর্বাধিক। এছাড়া বার্সেলোনায় প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে মেসি ২৬ শিরোপা জিতেছেন, যা ক্লাবটির ইতিহাসে কোনো খেলোয়াড়ের সর্বাধিক শিরোপা জয়ের ঘটনা। বার্সেলোনার চার চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা জয়ের সাক্ষীও মেসি। যা তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। এ এছাড়া একমাত্র ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনার দুবার ট্রেবল শিরোপা জয়ের কারিগরও তিনি। ২০০৮-০৯ মৌসুমে ট্রেবলসহ মোট ৬ শিরোপা জেতে বার্সেলোনা। আর গত বছর ট্রেবলসহ জেতে ৫ শিরোপা। গত সপ্তাহে এস্পানিওলের বিপক্ষে কোপা দেল রে’য় জোড়া গোল করে দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন ৬ প্রতিযোগিতায় গোল করার কৃতিত্ব দেখান মেসি। এর আগে যে কীর্তি ছিল একমাত্র পেদ্রো রদ্রিগেজের (সাবেক বার্সা তারকা)।
গত বছর শেষে দিকে জাপানে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে বার্সেলোনার কোচ মেসিকে ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হিসেবে অভিহিত করেন। তার এই দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে সামনে ভেসে ওঠে পেলে ও ম্যারাডোনার নাম। প্রশ্ন ওঠে- মেসি কি তাহলে তাদের চেয়েও ভালো। পেলে ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০- তিনবার ব্রাজিলকে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিয়েছেন। কিন্তু মেসি তার দেশকে একবারও এ শিরোপা এনে দিতে পারেননি। এই মানদণ্ডে অনেকে পেলের চেয়ে মেসিকে অনেক পিছিয়ে রাখেন। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, পেলে তার ফুটবল ক্যারিয়ারে কখনও ইউরোপে খেলেননি। আর এখনকার মতো এমন কঠিন ডিফেন্স তাকে ভেদ করতে হয়নি। অথচ মেসি এখন কঠিন কঠিন ডিফেন্স ডাল-ভাতের মতো ভেঙে দিচ্ছেন। সামনে আসে দিয়েগো ম্যারাডোনা প্রসঙ্গ। অনেক আর্জেন্টাইন মনে করেন দেশকে বিশ্বকাপ শিরোপা জেতাতে না পারলে মেসি কখনও ম্যারাডোনার সমকক্ষ হতে পারবেন না। এটা সত্য- ১৯৮০-র পর আর্জেন্টিনা মধ্যমানের একটি দল ছিল। কিন্তু ম্যারাডোনার অসাধারণ নৈপুণ্যে তারা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতে। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতা ফাইনালে ম্যারাডোনা গোল করতে ব্যর্থ হন। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে জর্জ লুইসের গোল শিরোপা নিশ্চিত করে আর্জেন্টিনার। মেসির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। তিনি ২০১৪ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেন। তবে ফাইনালে গোল করতে না পারায় শিরোপা হাতছাড়া হয় আর্জেন্টিনা। এখানে ম্যারডোনা ও মেসি সমান। এবার গঞ্জালো হিগুইয়েন যদি ১৯৮৬ সালের জর্জ লুইসের ভূমিকা পালন করতে পারতেন তাহলে বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার ঘরেই উঠতো। কিন্তু জার্মানির বিপক্ষের ফাইনালে দুইবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন হিগুইয়েন। ম্যারাডোনার ক্লাব ক্যারিয়ারটা বেশি উজ্জ্বল ছিল ইতালির ক্লাব নাপোলিতে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এই ক্লাবটির হয়ে ম্যারাডোনা জেতেন মাত্র ৫ শিরোপা। আর তার পুরো ক্যারিয়ারেই ছিল মাত্র ১০ শিরোপা। আর মেসি ২৮ বছরের মধ্যেই ইতিমধ্যে জিতে নিয়েছেন ২৬ শিরোপা।
সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু মেসির বার্সেলোনার স্প্যানিয়ার্ড সাবেক সতীর্থ জাভি হারনান্দেজের একটি কথায় শেষ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘পেলে এবং ম্যারাডোনা ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তারা ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন ফুটবলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। খেলোয়াড়দের গোল পাওয়াটাও অনেক কঠিন। কঠিন কঠিন সব রক্ষণ। প্রতিটি দলের থাকে নানা কৌশল। সবকিছু বিবেচনা করে আমি বলবো, মেসি সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ ফুটবলার।’
কে কী পুরস্কার পেলেন
ফিফা ব্যালন ডি’অর: লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা, আর্জেন্টিনা)
বর্ষসেরা নারী ফুটবলার: কার্লি লয়েড (যুক্তরাষ্ট্র)
ফিফা পুসকাস পুরস্কার: ওয়েনডেল লিরা (ব্রাজিল)
বর্ষসেরা কোচ: লুইস এনরিকে (বার্সেলোনা)
বর্ষসেরা নারী কোচ: জিল এলিস (যুক্তরাষ্ট্র)
সংখ্যায় মেসির কীর্তি
১* তিনের অধিক ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জেতা একমাত্র ফুটবলার লিওনেল মেসি। এবারের আগে তিনি ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে এ পুরস্কার জেতেন।
৫২* ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনা ও বার্সেলোনার হয়ে ৫২ গোল মেসির।
৪৩০* বার্সেলোনার হয়ে এখন পর্যন্ত ৫০৩ ম্যাচে তার গোল ৪৩০।
.৮৫* বার্সেলোনার হয়ে ম্যাচপ্রতি গড়ে তার গোল।
২৬* বার্সেলোনার হয়ে মেসির শিরোপা। এ ক্লাবটির হয়ে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার সঙ্গে সর্বোচ্চ শিরোপা জেতার ঘটনা এটি।
২৯৫* স্প্যানিশ লা-লিগায় তার গোল। কিংবদন্তি দেলমো জারার চেয়ে ইতিমধ্যে তার ৪৪ গোল বেশি।
২৮* বার্সেলোনার হয়ে তার হ্যাটট্রিক।
৪৯* আর্জেন্টিনার হয়ে ১০৫ ম্যাচে মেসির গোল।
১৬* এ বয়সে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে মেসির অভিষেক হয়।
৫৮,০০০,০০০* ‘মেসি’র নাম নিয়ে ২০১৫ সালে এ সংখ্যক টুইটার বার্তা মানুষ আদান-প্রদান করেছে।
কে কত শতাংশ ভোট পেয়েছেন
খেলোয়াড় ক্লাব দেশ ভোট (%)
লিওনেল মেসি বার্সেলোনা (স্পেন) আর্জেন্টিনা ৪১.৩৩
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ (স্পেন) পর্তুগাল ২৭.৭৬
নেইমার বার্সেলোনা (স্পেন) ব্রাজিল ৭.৮৬
লেওয়ানদস্কি বায়ার্ন মিউনিখ (জার্মানি) পোল্যান্ড ৪.১৭
লুইস সুয়ারেজ বার্সেলোনা (স্পেন) উরুগুয়ে ৩.৩৮
টমাস মুলার বায়ার্ন মিউনিখ (জার্মানি) জার্মানি ২.২১
ম্যানুয়েল নয়্যার বায়ার্ন মিইনখ (জার্মানি) জার্মানি ১.৯৭
ইডেন হ্যাজার্ড চেলসি (ইংল্যান্ড) বেলজিয়াম ১.৩৩
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বার্সেলোনা (স্পেন) স্পেন ১.২৪
আলেক্সিস সানচেজ আর্সেনাল (ইংল্যান্ড) চিলি ১.১৮