আশ্রয় কেন্দ্র বলতে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা। সেগুলোতে ৩-৪ ফুট পানি। কবরস্থানে পানি, মানুষ মারা গেলে? যখন মারা যাবে তখন ভাবা যাবে। এমন উত্তর হাকালুকি হাওর তীরের মানুষের। আশ্রয় কেন্দ্রে যাবে, সরকারি ত্রাণ আসবে। এসবের আশায় মানুষ করেনা। হাকালুকি হাওর তীরের মানুষের একটাই কথা- আমরা ত্রাণ চাই না, বন্যার এই ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ চাই। আর পরিত্রাণের এই একটাই পথ- হাকালুকি হাওরের সাথে কুশিয়ারার সংযোগস্থলের সেই বুড়িকিয়ারি বাঁধ অপসারণ অথবা বর্তমান সংযোগস্থল জুড়ী নদী খনন ও প্রশস্থকরণ।
এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর পাড়ের কুলাউড়া উপজেলার ৭ ইউনিয়নের লক্ষাধিক বানভাসী মানুষ চলতি বন্যায় চরম দূর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। ২য় দফা এ বন্যায় হাওর পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের শতভাগ মানুষের বাড়িঘরে পানি উঠায় চরম দূর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন এ ইউনিয়নের ৪৫ হাজার মানুষ। পৌরসভা এলাকার বিহালা, সোনাপুর, বিছরাকান্দি এলাকায় মানুষের ঘরে হাটুপানি। এছাড়াও বরমচাল, ভাটেরা, কাদিপুর ও জয়চন্ডি ইউনিয়নসহ মোট লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গত বুধবার সারা দিন ও রাতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় হাওরের পানি কমেনি। ফলে চরম দূর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন বানভাসী মানুষ। বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার ৬-৭ দিন অতিবাহিত হলেও সরকারী সাহায্য না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন হাওরপারের দরিদ্র মানুষ জন। আর সাহায্য প্রার্থীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
২১ জুন বুধবার হাওরপারের শতভাগ বন্যায় আক্রান্ত ভুকশিমইল ইউনিয়নে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, বন্যার পানির নীচে ইউনিয়নের সকল রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। ঈদ মৌসুমে এলাকার মানুষজন শহরের আসতে চরম দূর্ভোগের শিকার হন। রাস্তাঘাট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নৌকাযোগে গাদাগাদি করে নারী পুরুষরা শহরে আসতে দেখা যায়। অস্থায়ীভাবে কুলাউড়ার পৌর এলাকার বিহালা গ্রামে এবং ভুকশিমইল গ্রামে নৌকার ঘাট স্থাপিত হয়েছে। মানুষজন নৌকাযোগে চলাফেরা করছেন। কিন্তু নৌকা স্বল্পতার কারণে নদী পথেও যোগাযোগ সময় সাপেক্ষ এবং অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে বানভাসী মানুষের। নৌকাযোগে বন্যায় আক্রান্ত ভুকশিমইল, বাদে ভুকশিমইল, চিলারকান্দি, জাবদা, সাদিপুর, মুক্তাজিপুর, কাড়েরাসহ আরও কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের বাড়ি ঘরে পানি উঠেছে। কারও বাড়িতে কোমর পানি, আবার কারও বাড়িতে হাটু পানি। ঘর থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। চর্তুদিকে পানি আর পানি। যাদের নৌকা আছে তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন। আর যাদের নৌকা নেই তারা আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের বাড়িতে।
ভুকশিমইল গ্রামের ফয়জুল মিয়া ওরেফে ফয়জুল পীর জানান, তার টিন শেডের ঘরের কোমর পানি। তাই এ ঘরে বসবাস করতে পারায় ঘরের সকল মালামাল ফেলে উঠেছেন আত্মীয়ের বাড়ীতে। ছেলেরা ঘর পাহারা দেয়। একই গ্রামের সোহাগ, তাহির আলী, জাবেদ, জবলু ও সাজু জানান, তাদের সকলের বাড়িতে হাটু পানি। কারও বাড়িতে কোমর পানি।
ভুকশিমইল গ্রামের কুমুদিনী বিশ্বাস, নুর উদ্দিন,পাখি মিয়া, মনসুর, এমদাদ, জামাল, বিনয় ও হেকিম জানান, জানান, ৪-৫ দিন থেকে পানিবন্দি অবস্থায় আছি। ঘরের চুলাও পানিতে ডুবে গেছে। তাই রান্না বান্না করতে পারছিনা। তাই অনেকটা না খেয়ে আছি । এছাড়াও তাদের বাড়িঘরে পানি উঠায় তারা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের দেখার কেউ নেই।
ইউনিয়নের মেম্বার নজরুল ইসলাম ও সায়রুল ইসলাম জানান, ভুকশিমইল ইউনিয়নের শতভাগ মানুষ পানিবন্দি। গরীব মানুষের নৌকা না থাকায় বাড়ি ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। শতাধিক পরিবার বাড়িছাড়া। কোন আশ্রয় কেন্দ্রে নয়, কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আবার কেউ কেউ গ্রামের উচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এখানকার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যায় না কারণ পারস্পরিক সম্প্রীতি রয়েছে। ভয়াবহ বন্যা হলে উচু বাড়ির মালিকরা বানভাসীদের মানুষের প্রতি সহানুভুতিশীল থাকে।
এ ব্যাপারে ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, গত এপ্রিলের আকষ্মিক বন্যায় হাকালুকি হাওরে বন্যায় বিশেষ করে ভুকশিমইল ইউনিয়নের হাজার হাজার একর বোরো ধান পচে বিনষ্ট হয়। সে বিপদ কাটতে না কাটতে গত সপ্তাহে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে হাকালুকি হাওরে। আর এ বন্যায় হ্ওার পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের শত শত মানুষের বাড়ি ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। কিন্তু সরকারী ত্রান একবারেই অপ্রতুল। মানুষের চাহিদা কোনভাবে মেটানো যাচ্ছেনা। হাকালুকি হাওরের সেই বুড়িকিয়ারী বাঁধটি অপসারণ করা হলে বন্যা এত ভয়াবহ হত না। বাঁটি অপসারণ করা না হলেও হাওরের সাথে যে সংযোগ নদী অর্থাৎ জুড়ী নদীটি খনন ও প্রশস্থ করা হলে দ্রুত পানি কুশিয়ারা নদী দিয়ে চলে যেত।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌঃ মোঃ গোলাম রাব্বি জানান, বন্যা কবলিত এলাকায় ঈদ উপলক্ষ্যে ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হচ্ছে। তাছাড়া বন্যাকবলিত ৭ ইউনিয়নে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে কোন বরাদ্ধ আসেনি।