‘শাড়ি কি পছন্দ হয়েছে মা’? ‘খুবই পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া তুমি নিজে পছন্দ করে কিনেছো, আর আমার পছন্দ হবে না’। কত সহজ আর সাবলীল উত্তর। রাত পোহালেই ঈদ। ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ। কিন্তু কেন জানি বারবার মায়ের মুখটিই চোখে ভাসছে। স্নেহের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। আর সে ভাণ্ডার কখনও খালি হতে দেখিনি, মায়ের জীবদ্দশায়। মায়ের প্রিয় মুখ সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছি। এই প্রথমবার মাকে (শাশুড়ি মা) ছাড়া আমরা ঈদ উদযাপন করবো।
একটা সময় ছিল আমরাই ঈদের ছুটিতে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতাম। মা নিজেও আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেন। আমরা কখন আসবো, ক’দিন থাকবো, কী খাবো- নানারকম আয়োজন আর পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুত থাকতেন। সবাইকে নিয়ে ঈদ করার মজাই আলাদা। তারপর থেকে এই ধারা অব্যাহত ছিল বহু বছর। আমার ছেলের কাঁধে যখন স্কুল ব্যাগ উঠলো সেই থেকে এ ধারায় ছেদ পড়লো। সেসময় থেকে আবার বাবা-মা (শ্বশুর-শাশুড়ি) চলে আসতেন আমাদের সাথে ঈদ করবেন বলে। তাঁদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ ছিল দু’জনের চোখের মণি, আদরের একমাত্র প্রিয় নাতির সাথে ঈদ করার আনন্দ! বাবার মৃত্যুর পর সে ধারাটাতেও কিছুটা পরিবর্তন হল পরিস্থিতির কারণে। বাবুর বাবা যত ব্যস্তই থাকতেন না কেন, ঈদের আগে মাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসার কথা কখনই ভুলে যেতেন না। ঈদে প্রথম কাজই যেন মাকে আমাদের বাসায় নিরাপদে আনতে যাওয়া এবং বেড়ানো শেষ হলে আবার নিজেই পৌঁছে দিয়ে আসা। আর এ দায়িত্বটি পালন করেছেন মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। কখনও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর আমি আর আমার ছেলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম মা কখন এসে পৌঁছাবেন তার জন্য।
মায়ের আসাটা আমাদের জন্য ঈদের প্রধান আকর্ষণ। মনে পড়ে, রোজার মাঝামাঝি বা শেষের দিকে মা আসতেন। আমাদের ঈদের আনন্দ যেন সেখান থেকেই শুরু হতো। নিয়মিত রোজা রাখবেন। আমি খুবই যত্ন করে ইফতারিতে আমড়া, শশা, আম, কামরাঙা সালাদ কাটার দিয়ে কেটে মায়ের খাওয়ার উপযোগী করে সামনে দিতেই হেসে ফেলতেন। মিষ্টি করে বলতেন, ‘আমাকেও খেতে হবে? এত কষ্ট করলে বৌমা’? ‘আমরা খাবো, আর আপনি খাবেন না মা’? জবাব দিতাম আমি।
ঈদের দিন রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখি উঁচু মোড়াতে বসে আছেন মা। জানতে চাইতাম, ‘এখানে কী করছেন’? ছোট্ট করে বলতেন, ‘তুমি গরমের মধ্যে আমাদের জন্য রান্নাবান্না করবে। আমিও রান্নাঘরে থাকি না মা। আমি গল্প করছি, তুমি শুনতে শুনতে রান্না করো, দেখবে ভালো লাগবে।’
আজ মা বেঁচে নেই, শুধু নিবিড়ভাবে অনুভব ও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করছি, এবারের ঈদে আমার জন্য সেভাবে ভাববার আর কেউ থাকলো না।
এই প্রথমবার বাবুর বাবা আর আমার ছেলে মাকে সালাম না করেই ঈদগাহে যাবেন নামাজ পড়তে। আমাদের পরিবারে পুরো ঈদের আনন্দই যেন ছিল মাকে ঘিরে! সারাক্ষণই সবাইকে খাওয়ার তাগিদ দিতেন। বিশেষ করে মা তাঁর একমাত্র নাতির খেয়াল রাখতেন সবসময়। আদর করে নাতিকে ডাকতেন ‘প্রদীপ’ বলে। সবসময়ই সবাইকে শোনাতেন, ‘এই আমার বংশের প্রদীপ’। ঈদের দিন নাতির বন্ধুরা এলে সবার কুশল জিজ্ঞাসা করতেন, কার কোন খাবার পছন্দ সেটা খাওয়ার জন্য বলতেন। ছেলের বন্ধুরা অনেকেই মন্তব্য করেছে, ‘তোর দাদু অমায়িক, মিশুক আর খুবই আধুনিক। কী গুছিয়ে কথা বলেন! চমৎকার মানুষ’।
আমার ছেলের গায়ে টোকা দেয়ার সাধ্য কারুর ছিল না। আমি বাবুর ওপর খেপে গেলে সোজা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাবুকে আড়াল করে রাখতেন। ‘মা, যা করবার আমাকে করো, কিন্তু ভাইকে কিছু বলবে না’। মায়ের ভালোবাসা এমনই অকৃত্রিম ছিল।
গত বছরের ৮ নভেম্বর মা চলে গেছেন অনন্তলোকে। আল্লাহ্পাক তাঁকে বেহেশত নসীব করুন। মাকে ছাড়া ঈদ সত্যি কষ্টের, বেদনাদায়ক। মাকে আমরা ভুলিনি, ভুলবো না। পুত্রবধু হিসেবে আমি ওঁনার কতটা পছন্দের ছিলাম জানি না; তবে উনি আমাকে শেষবার ঈদ করে যাওয়ার সময় বলে গেছেন, ‘দোয়া করি মা, তোমার ছেলের জন্য তোমার মতো একজন বউ পাও’।
এই আশির্বাদটুকু আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। পারিবারিক জীবনে একজন মায়ের ভূমিকা সারাজীবন থাকে। জাগতিক জীবনেও তিনি সবচেয়ে বিশাল এক ভরসাস্থল। আজ ঈদের এই শুভক্ষণে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি, আপনার অনুপস্থিতিতে। আপনার প্রতি রইলো আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। আবেগ আর আকুলতার অনুভবে, সব ভালোলাগায় এক বিশাল প্রতিচ্ছবি হয়ে আপনি থাকবেন আমাদের মনে-প্রাণে।