“উপহার” সেলিনা আক্তার ।

শেখ সাদি, স্বদেশ নিউজ ২৪.কমঃ 
ভ্যালেন্টাইন’স ডে তে বিয়ে করতেই হবে।প্রেমিক মানেই পাগল! এই পাগলামী নিয়ে চলে কত আয়োজন,কত মাতামাতি!সে এক অদ্ভূত অনুভূতি,যারা এসব পাগলামী করেছে তারা জানে,জানবে পৃথিবীর সব প্রেমিক।সব প্রেমিকের মতো আমাদের মাঝেও কত রকম পাগলামী যে ছিল, রীতিমত অবসেশন যাকে বলে।ভালোবাসা দিবস, ভালোবাসার মানুষ গুলোকে রাঙিয়ে দিয়েছে,দিয়েছে কাঁদিয়েও।দিনটি কারো কাছে নতুন স্বপ্ন, নতুন কিছু আশা, নতুন অঙ্গীকার,কারো কাছে শুধু স্মৃতি।না চাইলেও স্মৃতির মাঝে বার বার উঁকি দেয় পুরনো দিন। কলেজ জীবনের বন্ধু,ভালোবাসতে কবে যে শুরু করেছিলাম দুজ’নে জানি না কিন্তু একদিন ঝগড়া করতে করতে ধরা পড়ে গেলে সেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল,তখন মাত্র ইউনিভার্সিটির জীবন শুরু।
ক্লাস শেষে দেখা হতো প্রতিদিন,আমি কলা ভবন থেকে সোজা চলে যেতাম কার্জন হলের মাইক্রোবায়োলজির ল্যাবে,ব্যস্ত থাকলে বলতো সন্ধ্যায় আসবে হলের গেটে ।

অপেক্ষায় থাকতাম কখন আসবে,আমার নামে একটা চিরকুট বাইরে যাবার জন্য । যা হলের দাদুরা নিয়ে আসতেন।সে প্রতীক্ষা ছিল জীবনের মধুর অধ্যায়, অন্যরকম পৃথিবী। সেই ছাত্র জীবনে আমাদের দু’জনেরই তেমন বেশী উপহার দেয়ার মতো অবস্থা ছিল না ।প্রথমবার নতুন বছরের উপহার হিসেবে ডায়রী, কলম আর ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলাম, সে গুলো পেয়ে সে আমাকে বিশাল চিঠি লিখেছিল, একটা লাইন ছিল এরকম ,” ইচ্ছে ছিল তোকে সারপ্রাইজ দিবো কিন্তু তার আগে তুই আমাকে হারিয়ে দিলি আমি এখন দেয়ার চেয়ে প্রাপ্তির আনন্দে বেশী ভূগছি”।তারপর থেকে ভালোবাসায় কে বেশী প্রবল তাই ছিল আমাদের সারপ্রাইজের বিষয়।তখন মোবাইল ছিল না,চিঠিই ছিল ভরষা।দেখা হতো তবু আমরা প্রতিদিন চিঠি লিখতাম, যাবার সময় একজন আরেকজনের হাতে ধরিয়ে দিতাম চিঠি।ছাত্র জীবন শেষ হলে আমি ঢাকা সিটিসেল অফিসে চাকুরী শুরু করলাম , সে শুরু করল আর্চিজ গ্যালারীর ব্যবসা।সব ভ্যালেন্টাইনে ও আসতো ঢাকায় ।

একবার হরতালের জন্য আসতে পারলো না তবুও আমি উপহার পাঠালাম। সে দিনও খুব অবাক হয়েছিল।একশত টাকা বাড়তি দিয়ে আগে ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম।বলেছিলাম ,”মরে গিয়ে ভুত হয়েও তোমার জন্য উপহার পাঠাবো”।কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন ,সব সময় সব কিছু গ্রহণ করতে পারে না।এখনও একই শহরে থাকি,খুব কাছাকাছি ঠিকানাও ও জানি তবুও আমার সে কথা রাখতে পারিনি ,মরে গিয়ে ভূত হয়ে আসা কি হবে?তবে এক জীবনে সে যে সব মনোহর উপহার দিয়েছে তা দেখে আমার এ জন্ম চলে যাবে। রাগ করে অনেক কিছু ভেঙ্গে ফেলেছিলাম তারপরও এখনো আছে অনেকগুলো সুন্দর কোমল টেডিবিয়ায়। প্রায় তিনশত চিঠি।

একবার দিয়েছিল ,একটা মাটির ঘর যার ভিতরে ছিল এক জোড়া মানব মানবী ,যেখানে ইংরেজীতে লিখা ছিল , “ঘর সেখানে ভালোবাসা যেখানে”। সে কথাটা তার জন্য কতটা সত্য জানি না কিন্তু আমার জন্য এক কঠিন সত্য ।যেহেতু পূর্ব পরিচিত আমরা দু’জনেই জানতাম দু’জনের ঘরের খুঁটিনাটি সব। আমি সে ঘরের পরে আর কোনো ঘরের স্বপ্ন কখনোই দেখিনি এবং নিজের ঘরে থাকলেও সব সময় মনে হতো আমি তার কাছে বা সে আমার কাছে । তাই দূরে গিয়েও দূরে যাওয়া হতো না। মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর থেকে আমরা শুধু অপেক্ষা করলাম বিয়ে করে ফেলবো কোনো এক ১৪ ই ফেব্রুয়ারীতে,কিন্তু সে তার মাকে মানাতেই পারে না।পর পর দু’বছর ভ্যালেন্টাইন ডে তে শাড়ী পরে রেডি হয়েও আমরা কাজী অফিসে গেলাম না যে দেখি তার মা মানেন কি না ।

প্রতিবার সে ই বলতো যে ,”চল নিজে নিজে বিয়ে করে ফেলি”। পরের বছর আবারও ফেব্রুয়ারীতে সে বলল ,”এ বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করে ফেলবো”। আমি বললাম , “১৪ই ফেব্রুয়ারি আমার জন্য লাকি না ,পরশু দিন ৮ তারিখ আমার অফিস বন্ধ,করলে এ দিনই করি নতুবা কিছু বলার দরকার নেই “।এবং সেই ৮ই ফেব্রুয়ারী আমরা বিয়ে করলাম। প্রেমের বয়স দশ বছর হলেও বিয়ের পর পরই আসল গজব নেমে আসলো।সাহস করে মাকে কিছু বলতো না তবে তার মায়ের পছন্দের মেয়েকে ফোন করে বলতো , “আমার মা আংটি নিয়ে গেলে প্লীজ পরবেন না অন্য একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে”।

কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম না ,যদি আজাদ না বলতো। একবার শেহনাজ নামে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে সোফায় এসে বসেছিল দু’হাত বগলে লুকিয়ে।ওর দু’লাভাই আম্মা হাতে আংটি নিয়ে বসে ছিলেন অনেক্ষণ , কিন্তু সে মেয়ে হাত বের করেনি। আজাদ বলেছিল, সে নাকি ফান করে বলেছিল, “হাতের আঙ্গুল কি কাটা”?শেহনাজের মত সম্ভবত খুব কম মেয়ে আছে।তাইতো শেষ রক্ষা হলো না। জীবনের অনেক প্রতিকূলতার মাঝে প্রথম বাচ্চা টার চেহারা দেখলাম না।বলতো “সে বাচ্চা থাকলে হয়তো জীবন অন্য রকম হতো,মা মেনে নিতেন”।কথা হলো ভালো থাকা না থাকার জন্য অদৃষ্ট কোনো শর্ত চায় না ।

তারপরও আমি ভালো আছি সুখে না হোক শান্তিতে।যা পেয়েছি মনে হয় তাইতো অনেক।এক ১৪ই ফেব্রুয়ারীতেই ঈশায়া কে বিধাতাই পাঠালেন আমার জন্য পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ট উপহার করে ,পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং সেরা ভ্যালেনটাইন’স গিফ্ট।মেয়েটা যে শুধু বাপের কার্বন কপি তা নয় ওর গায়ের খুশবো টা পর্যন্ত বাপের গায়ের মতো। অনেকগুলো অভ্যাসও আমাকে অবাক করে দেয়। দিনটা অনেকের কাছে সৌজন্যতা আমার কাছে অনেক বড় কিছু।পহেলা বৈশাখের মেলায় গ্রামীণ ফোনের এক মডেল একবার ঈশায়া কে বলেছিল,” মা গো এ দিকে আসো তোমার কিছু ছবি তুলি, আল্লাহ তোমাকে নিজের হাতে বানিয়েছেন “।

সত্যিই তাই ,আমি আমার ভালোবাসার জন্য খুব সৎ ছিলাম তিনি বিমুখ করেননি ।বিধাতার নিজের হাতে বানানো সেই উপহার আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি হেরে গিয়ে জিতে গেছি।আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *