ব্যাংকের চেক জালিয়াতি করে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সাতজনকে আটক করেছে র্যাব। আটককৃতদের মধ্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার কর্মকর্তা ওয়াহেদুজ্জামান সোহেল ও গুলশানের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের নিরাপত্তারী আল আমিন রয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উত্তরা, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয় বলে র্যাব জানায়।
র্যাব সদর দফতরের সহকারী পরিচালক মাকসুদুল আলম জানিয়েছেন, জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তি এই চক্রের হোতা। তারা ব্যাংকের চেক জালিয়াতি করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করত। তাদের কাছ থেকে প্রায় ২০০ চেক, সিল, কম্পিউটার, ব্যাংক স্ট্যাটমেন্টসহ জরুরি নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন : চেক জালিয়াতি চক্রের প্রধান মো: জাকির হোসেন, সহযোগী সোনিয়া আক্তার ওরফে লিপি, মো: আবুল কালাম শেখ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা ওয়াহেদুজ্জামান সোহেল, কর্মচারী মো: আল আমিন ওরফে সুমন, উত্তরা ও সিটি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মো: রিজভী খায়ের ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক লোন শাখার কর্মকর্তা আবুল কাশেম প্রমাণিক স্বপন।
গতকাল বিকেলে র্যাব সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, এই প্রতারক চক্রের মূল হোতা জাকির হোসেন। তিনি ব্যাংকে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে চেক জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিলেন। জাকির হোসেন চলতি মাসে ৪০৭/৯ ডিওএইচএস, বারিধারায় হোসেন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস হিসেবে ভাড়া নেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী হিসেবে সোনিয়া আক্তারকে এবং হারুন-অর রশীদকে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেন। তারা মূলত যে কারো স্বার স্ক্যানিং করে জাল চেক তৈরি করতেন। সোনিয়া আক্তার ২০১১ সালে অফিস সহকারী হিসেবে ছয় হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক জাকির হোসেনের খুবই বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। প্রতারক জাকির হোসেন তাকে চেক জালিয়াতির কাজে চেকের ওপর এমআইসিআর লেখা (নম্বর কিভাবে কৌশলে ব্লেড দিয়ে ওঠানো এবং নতুন নম্বর প্রতিস্থাপন) কাজ শিখিয়ে দেন। পরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা চেকের ফটোকপি এবং বিভিন্ন নামে করা ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর ঘষা-মাজার কাজ করতেন তিনি। সোনিয়ার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ১৪-১৫টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ওই ব্যাংকগুলো থেকে নিয়মিত টাকা উত্তোলন, অ্যাকাউন্ট খোলা ও চেক সংগ্রহের কাজে চক্রের অন্যান্য সদস্য স্বপন, সোহেল, রিজভী, আবুল কালাম ও আল-আমিনের সাথে পরিচয় হয়। আল-আমিন ওরফে সুমন এলিট ফোর্স সিকিউরিটি কোম্পানির ডাচ-বাংলা ব্যাংক গুলশান শাখায় পিয়ন হিসেবে কর্মরত থাকায় গুলশান শাখার ডাচ-বাংলা ব্যাংকে জাকিরের সাথে পরিচয় হয়। আল-আমিন ওই ব্যাংকের চেকের কিয়ারিংয়ের কাজ করতেন এবং জাকিরের অনুরোধে চেক কিয়ারিং পাতার ফটোকপি টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করতেন। ওয়াহেদুজ্জামান সোহেল ২০০৮ সাল থেকে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের রিলেশনশিপ অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। দুই বছর আগে ডাচ-বাংলা ব্যাংক এলিফেন্ট রোড শাখায় হিসাব খোলার সুবাদে জাকিরের সাথে তার পরিচয়। পরিচয়ের পর জাকির তার কাছ থেকে মূল চেকের ফটোকপি নিতেন।
র্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, প্রতারক চক্রটি মূলত বিভিন্ন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ রেখে একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টকে টার্গেট করত এবং কর্মরত ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে এই সংক্রান্ত তথ্য নিত। মূলত যেসব প্রতিষ্ঠান যাদের লেনদেন বেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশী, যাদের অনেকেরই অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে, তাদের অ্যাকাউন্টই ছিল ল্য।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, এই চক্রের সাথে বিভিন্ন ব্যাংকের বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। এ পর্যন্ত এই প্রতারক চক্র চেক জালিয়াতি করে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানায় তারা। জিজ্ঞাসাবাদে এই চক্রের সাথে জড়িতদেরও গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে বলে মুফতি মাহমুদ জানান।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, গত ২৬ অক্টোবর সোনালী ব্যাংকের লালমাটিয়া শাখা থেকে গ্রাহকদের ৫৫টি চেক চুরি হলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। হারিয়ে যাওয়া এসব চেকের মধ্যে একটি জমা দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে টাকা তোলারও চেষ্টা হয়। ওই ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের লালমাটিয়া শাখার এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপ। গত দুই মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৪টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে চেক, ডিডি, এফডিআর ডকুমেন্ট, এসডিআর, এমটিডিআর, পে-অর্ডার, আমদানি-রফতানির এলসি ডকুমেন্টের মতো গ্রাহকদের গুরুত্বপূর্ণ নথি খোয়া যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। হারিয়ে যাওয়া নথি ব্যবহার করে অন্য ব্যাংকে জালিয়াতি ঠেকাতে প্রতিটি ঘটনার পর প্রত্যেক ব্যাংককে চিঠিও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়ে, সোনালী ব্যাংকের শিল্প মন্ত্রণালয় শাখার জাহিদুল ইসলাম নামে এক কর্মকর্তা ভুয়া হিসাব খুলে বিভিন্ন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ও ব্যাংকের হিসাব থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এর পরিপ্রেেিত বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের চিঠি দিয়ে এ ধরনের কর্মকর্তাদের সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দেয়।
–
আশিকুর রহমান চৌধুরী স্বদেশ নিউজ২৪.com