রাজধানীতে কিছু অসৎ পুলিশের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্রের নতুন নেটওয়ার্ক। এতে কাজ করছে পেশাদার ছিনতাইকারী, পুলিশ সোর্স এবং কয়েকটি থানার কিছু অসৎ পুলিশ সদস্য। ছিনতাইকারী ও পুলিশ সোর্সের পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ নিজেই অংশ নিচ্ছে ভয়ানক এই অপরাধের সাথে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্য নিজেদের থানা এলাকার পাশাপাশি বাইরে গিয়েও ছিনতাই করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুুগছেন রাজধানীবাসী। সাধারণ মানুষ বলছেন, যে পুলিশের ভরসায় তারা টাকা পয়সা বা অন্য মালামাল নিয়ে রাস্তায় নামেন সেই পুলিশ যখন ছিনতাইকারী রূপে সামনে আসে তখন নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না।
সূত্রমতে, সব ছিনতাই কাজে পুলিশ সরাসরি অংশ নেয় না। কেউ মোটা অঙ্কের টাকা বহন করছে বা ওই টাকা ছিনতাই করা সাধারণ ছিনতাইকারীদের পক্ষে সম্ভব নয়, এ ধরনের ক্ষেত্রে ওই টাকা ছিনিয়ে নিতে পুলিশ নিজেই ছিনতাই কাজে যোগ দিচ্ছে। তবে পুলিশের এ ধরনের কর্মকা-ের বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি রাজধানীতে পুলিশ কর্তৃক কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে টনক নড়েছে খোদ পুলিশ প্রশাসনের।
গত ৮ এপ্রিল দুপুরে বিকাশের এজেন্ট আবুল কালাম মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশনের অফিস থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে মোটরসাইকেলে ১০ নম্বর সেকশনের ব্র্যাক ব্যাংক শাখায় যাচ্ছিলেন। ব্যাংকের কাছাকাছি পৌঁছালে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আবুল কালাম ও সাইদুর রহমান নামে এক প্রাইভেটকার চালক আহত হন। এ ঘটনায় আবুল কালাম কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। কাফরুল থানা পুলিশ এই ঘটনার সাথে জড়িত চার ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যে পুলিশ জানতে পারে এই ঘটনার সাথে যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মঞ্জুরুল ইসলাম হাবিব ও রমনা থানার এসআই মোজাহিদুল ইসলাম জড়িত। পরে পুলিশ ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকেও গ্রেফতার করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।
মিরপুর জোনের পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রমনা ও যাত্রাবাড়ীর দুই এস আইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।
গত বছর ৫ অক্টোবর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে দুই ব্যবসায়ীর ৩০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিতে গিয়ে গণপিটুনি শিকার হয়েছেন তিন পুলিশ সদস্য। তারা হলেন, ক্যান্টনমেন্ট থানার সিভিল টিমের এসআই কাইয়ুম, কনস্টেবল আবুল খায়ের ও আলমগীর। ওই ঘটনায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ ও তিন পুলিশ সদস্যকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার করে।
সূত্র জানায়, দুপুর ১২টায় ক্যান্টনমেন্ট থানার এসআই কাইয়ুমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের পুলিশের একটি টিম তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ী চাঁন মিয়ার (৫০) বাসায় অভিযান চালায়। এ সময় ওই ব্যবসায়ীর বাসায় থাকা প্রায় ৩০ লাখ টাকাসহ চাঁন মিয়া ও আমান (৩৮) নামে অপর এক ব্যবসায়ীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। এ সময় ব্যবসায়ীরা ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার দিলে স্থানীয়রা পুলিশ সদস্যদের আটক করে গণপিটুনি দিতে থাকে। পরে প্রথমে বংশাল থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু ঘটনাটি কোতোয়াাল থানা এলাকায় হওয়ায় তাদের ওই থানায় স্থানান্তর করা হয়।
একই বছর ১০ ফেব্র“য়ারি মালিবাগে ছিনতাই করতে গিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা গণপিটুনির শিকার হন। তিনি হলেন রামপুরা থানার এসআই ইমরুল ফাহাদ। পরে থানা পুলিশ ওই এসআইকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ যে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে সেটি মানতে চায়নি থানা পুলিশ। সহকর্মীকে বাঁচাতে থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ভুল বোঝাবুঝি বলে জানান।
সূত্রমতে, ঘটনার দিন দুপুরে মালিবাগ বাজারের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মো: ইউনুস একটি গাড়িতে করে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে পাশের ইসলামী ব্যাংকে জমা দিতে যাচ্ছিলেন। পথে একটি মাইক্রোবাস তার গাড়ির গতি রোধ করে। সেখানে অস্ত্র হাতে নিয়ে কয়েকজন ছিনতাইকারী জোর করে ইউনুসকে মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি উঠতে না চাইলে ছিনতাইকারীরা তার হাতে থাকা টাকার ব্যাগ নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে থাকে। এ সময় ইউনুস চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। তারা ইমরুল ফাহাদকে আটক করলেও বাকিরা মাইক্রোবাস নিয়ে পালিয়ে যায়। জনতা ইমরুলকে গণপিটুনি দিতে থাকে। এ সময় তারা জানতে পারে ইমরুল রামপুরা থানা পুলিশের এসআই। পরে জনতা তাকে ধরে পাশের একটি পরিবহন কাউন্টারে আটক করে থানায় খবর দেয়। এ সময় কাউন্টারের বাইরে ব্যবসায়ীরা পুলিশের ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে রামপুরা থানা পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র সূত্র জানায়, এই চক্রটি পেশাদার ছিনতইকারীদের মতোই বিভিন্ন ব্যাংক ও টাকা লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের দিকে নজরদারি করে থাকে। নজরদারির কাজটি করে পুলিশের সোর্স ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা। বড় ধরনের কোনো চালান পেলে বা ওই চালানের সাথে কোনো অস্ত্র বা লোকসংখ্যা বেশি থাকলে সে অপারেশনে পুলিশ সদস্যরাই অংশগ্রহণ করে। বাকিগুলো তাদের তত্ত্বাবধায়নে সোর্স বা পেশাদার ছিনতাইকারীরা করে থাকে। তবে টাকার ভাগ ও চক্রের সাথে জড়িত পুলিশদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়।
সূত্র আরো জানায়, এই চক্রের সদস্যদের অস্ত্র নিয়ে টেনশন নেই। কারণ ছিনতাই কাজে তারা সরকারি অর্থাৎ পুলিশের অস্ত্রই ব্যবহার করে থাকে।
বিকাশ এজেন্টদের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সব সময় বলে আসছে বেশি টাকা বহন করলে তাদের সহযোগিতা নেয়া হোক। কিভাবে আমরা পুলিশের সহযোগিতা নেবো যেখানে পুলিশ নিজেই ছিনতাই, লুট ও ডাকাতির মতো কাজের সাথে জড়িত।
এ ব্যপারে জানতে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, এ ধরনের যে ক’টি ঘটনা পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের নজরে এসেছে তার প্রত্যেকটি বিষয়কে জিরো টলারেন্সের সাথে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া পুলিশের কোন সদস্য কোন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত এমন প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নদি