মৃত্যু উপত্যকা

35917_Death-Valley-300x190ডেস্ক রিপোর্ট : বাটির মতো দেখতে একটি উপত্যকা। নাম ‘ডেথ ভ্যালি’। বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘মৃত্যু উপত্যকা’। মানে ভয়ঙ্কর বা বিপজ্জনক কিছু একটা। সত্যিই তাই। পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে এখানে। ৫৬ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। অসহ্য গড়মে অধিবাসীদের হাসফাস অবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলকেও হার মানায় এখানের তাপমাত্রা। এখানকার আবহাওয়াটা প্রায় গ্রীষ্মম-লীয় মরুভূমির প্রচ- গরম, হালকা শীত এবং সামান্য বৃষ্টি। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের এই ডেথ ভ্যালি দেখতে।

উপত্যকাটি লম্বায় প্রায় ২২৫ কিলোমিটার আর চওড়া আট থেকে ২৪ কিলোমিটার। উত্তর আমেরিকার সব থেকে উষ্ণ ও শুকনো জায়গা এটি। পশ্চিম গোলার্ধের সব থেকে শুকনো নিম্ন ভূমিও এটি। এখানকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ৫ সেন্টিমিটার। জায়গাটির বিভিন্ন স্থানে যে সামান্য জলাশয়ের সৃষ্টি হয় তাও ভীষণ লবণাক্ত। সমগ্র উপত্যকাটি বালুতে পরিপূর্ণ।

ডেথ ভ্যালির মাটি এত শুষ্ক, লবণাক্ত ও বিষাক্ত যে, এখানে কোনো গাছপালাই জন্মাতে পারে না! জায়গাটি আবার এত নিচু যে, সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুপযুক্ত বিষাক্ত গ্যাস জমে যায়। এখানে যাওয়া মানে মৃত্যু অনিবার্য। তাই বোধ হয় নাম ‘মৃত্যু উপত্যকা’। আসলে কিন্তু তা নয়।

এর নাম ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হলো কেন তা নিয়ে অনেক মত আছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে ১৮৪৯ সালে যখন ক্যালিফোর্নিয়ার সুটারস কারখানায় স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায় তখন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ক্যালিফোর্নিয়াতে আসতে শুরু করে। ইতিহাসে এই সময়ের নাম ‘ক্যালিফোর্নিয়ার স্বর্ণের দৌড়’ (গোল্ড রাশ)। সেই সময় এক দল অভিযাত্রী গরুর গাড়িতে বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে স্বর্ণের সন্ধানে রওনা হয়। অক্টোবর মাসের কোনো এক দিন তারা সল্টলেক সিটি পৌঁছায়। সামনে বরফে মোড়া সিয়েরা পর্বত। পর্বতটি এ সময়ে অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় তারা সন্ধান পেল একটি ‘পুরনো স্প্যানিশ’ পথের। রাস্তাটা সিয়েরা পর্বতের দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে গিয়েছে। তবে এ পথে আগে কেউ কখনও যায়নি। কিন্তু স্বর্ণের লোভ বড় লোভ! যাত্রা শুরু হলো। সমস্যা বাঁধল যখন অভিযাত্রীদের একজন আরো একটি রাস্তা খুঁজে পেল। এই রাস্তাটি ‘ডেথ ভ্যালি’র মধ্যে দিয়ে। এই পথে তাদের ৫৫০ মাইল রাস্তা কম হবে। আগে পৌঁছনোর বাসনায় দলটি দু’ভাগ হয়ে গেল। একদল পুরনো স্প্যানিস পথ দিয়েই চলতে লাগল। আর অন্য দলটি যাত্রা শুরু করলো অচেনা ডেথ ভ্যালির মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তাদের কল্পনাতেও ছিল না, কী বিভীষিকা এ পথে অপেক্ষা করে আছে!

মাস খানেক উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে যখন খাবারপানি প্রায় শেষ, তখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো শুরু হলো তুষার ঝড়। আপাতভাবে দুর্ভাগ্যজনক মনে হলেও অভিযাত্রীদের কিন্তু এই দুর্যোগ সাহায্যই করেছিল। হয়তো শীতকাল বলেই সেই সুবিধা হয়েছিল তাদের। তুষার ঝড়ে প্রাকৃতিকভাবে অনেক পানির কু- তৈরি হয়। এই কু- অভিযাত্রীদের পানির কষ্ট লাঘব করে। কিন্তু খাদ্য সঙ্কট তো আর মেটার নয়। কথায় আছে ‘ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভ’! খাবারের অভাবে গাড়িটানা দুর্বল ও শুকিয়ে যাওয়া গরুগুলোর গোশত খেয়েই নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছিল তারা। পথের শেষে অভিযাত্রীরা যখন এই উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাদেরই একজন বলে ওঠে, ‘বাই বাই ডেথ ভ্যালি’। সেই থেকেই এটি ‘মৃত্যু উপত্যকা’ নামে পরিচিত।
ডেথ ভ্যালিতে কখনও কখনও দেখা দেয় ভয়ঙ্কর মরুঝড়। এমনিতেই বালির পাহাড় চড়া কঠিন! তার উপর সেটা আবার মরুঝড়ের মধ্যে চড়তে হলে কী অবস্থা দাঁড়ায়, ভেবেই শিহরণ জাগে।

ডেথ ভ্যালিতে ইচ্ছা থাকলেই কিন্তু যাওয়া যায় না। এজন্য সঠিক পরিকল্পনা খুবই জরুরি। ডেথ ভ্যালির অবস্থান লাস ভেগাস শহর থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে। ক্যালিফোর্নিয়া আর নেভাদা রাজ্যের সীমানায়। শুক্র ও শনিবার এখানে হোটেলের ভাড়া অনেক বেশি। রোববার থেকে আবার ভাড়া কমে যায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ, সেই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।

রংবেরঙের পাহাড় দেখলে মনে হয় প্রকৃতি এখানে দীর্ঘ দিন ধরে মার্বেল পাথর কেটে এগুলো বানিয়েছে। সকালবেলা সূর্যের আলো পড়ে সেই পাহাড় খুব সুন্দর রঙের খেলায় সেজে ওঠে। পাথরের উপর বিভিন্ন রঙের প্রলেপ- নীল, সবুজ, গোলাপি। জায়গাটি আসলে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে তৈরি হয়েছে। আর বিভিন্ন রঙের মধ্যে লাল, হলুদ আর গোলাপি রং হয়েছে লোহার নানা যৌগ থেকে। মাইকা সৃষ্টি করেছে সবুজ রং আর ম্যাঙ্গানিজ তৈরি করেছে রক্তাভ। ক্যালিফোর্নিয়ায় অনেক ভারতীয় আছে। যাদের কাছ থেকে এখানকার স্থানীয় লোকেরাও অনেক ছোট ছোট হিন্দি শব্দ-বাক্য শিখে গিয়েছে। একইভাবে অনেকে বাংলাও জানে।

ডেথ ভ্যালির মধ্যে ‘ব্যাড ওয়াটার বেসিন’ অন্যতম দর্শনীয়। কারণ এটি আমেরিকা তথা পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে নিচু জায়গা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট নিচে। অবশ্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জায়গা এটি নয়। সবচেয়ে নিচু জায়গা ইসরাইল আর জর্ডনের মধ্যে অবস্থিত মৃত সাগর বা ডেড সি। সমুদৃপৃষ্ঠ থেকে এটি এক হাজার ৩৭১ ফুট নিচু। ব্যাড ওয়াটার বেসিনের পার্কিং লট থেকে কাঠের রাস্তা নেমে গেছে। জায়গাটা ভেজা ভেজা এবং লবণাক্ত। মাটিতে লবণের প্রলেপ লেগে সাদা হয়ে রয়েছে। সাদা লবণাক্ত জমির মাঝে মাঝে ছোট ছোট গর্তে পানি জমে। পাশের পাহাড়ের উপরে সমুদ্রপৃষ্ঠের সীমা চিহ্নিত করা আছে। চারিদিক ফাঁকা, সাদা মাঠ খাঁ খাঁ করে। দূরে এই পার্কের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ ‘টেলিস্কোপ পিক’ বরফ-চাদর জড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরো দক্ষিণে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে অ্যাশবোর্ড কারখানার ধ্বংসাবশেষ। যেখানে আগে সোনার আকরিক পরিশোধন করা হতো। কাছাকাছিই ফার্নেস ক্রিক দর্শনার্থী কেন্দ্র। মরুভূমির মধ্যে যেন একটা মরুদ্যান। এখানে খাবারদাবারসহ অনেক কিছুই পাওয়া যায়। যদিও দামটা একটু বেশি। ভিজিটর সেন্টারে একটা সুন্দর জাদুঘর আছে। সেখানে উপত্যকার বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক নিদর্শন রাখা আছে।

ডেথ ভ্যালির ‘রেস ট্র্যাক প্লায়া’ এমন এক রহস্যময় জায়গা যেখানে ফাঁকা মাঠের মধ্যে বড় বড় পাথর রয়েছে। এই অঞ্চলে খুব জোরে হাওয়া প্রবাহিত হয়। আর বৃষ্টিতে মাঠে পানি জমে পিচ্ছিল হয়ে গেলে হাওয়ায় এই পাথরগুলো গড়াতে শুরু করে। আর তার ফলেই তৈরি হয় এই রেস ট্র্যাক। তবে এখানে যাওয়ার জন্য ভালো রাস্তা নেই। প্রায় ২৭ মাইল এবড়োথেবড়ো পাথুরে রাস্তা। ফলে চার চাকার গাড়ি ছাড়া গতি নেই। এটা না থাকলে পার্ক কর্তৃপক্ষও যেতেও দেবে না।

রেস ট্র্যাকের কাছে স্কটি ক্যাসল বা স্কটি দুর্গ বলে একটা জায়গা আছে। স্কটি ক্যাসলে ঢুকতে টিকিট কিনতে হয়। পথে হারমোনি বোরাক্স কারখানা। কাচ তৈরিতে অপরিহার্য উপাদান হলো বোরাক্স। সান ফ্রান্সিস্কোর ব্যবসায়ী উইলিয়াম কোলম্যান এই কারখানাটির পত্তন করেন। উপত্যকায় প্রাপ্ত কটনবল বোরাক্স পরিশোধিত করা হতো এখানে। এখন কারখানায় ব্যবহৃত জিনিসের নিদর্শন রাখা আছে। যে কাঠের বগি করে বোরাক্স পরিবহণ করা হতো সেটিও আছে। ২০ খচ্চরের গল্প এই বগিকে ঘিরেই। বিশাল বিশাল দু’টি ওয়াগানে খনিজ ভর্তি করে, আর একটা ট্যাঙ্কারে পানি ও খাবারদাবার নিয়ে ১০ দিন এই ভয়ঙ্কর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে ১৬৫ মাইল দূরের রেল স্টেশনে ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৯ সাল অবধি এই ২০ খচ্চরের গাড়ি খনিজ পরিবহণ করেছে। তখনকার দিনে এটা ছিল কোম্পানির অন্যতম বিজ্ঞাপন।

সরকারি হিসাবে এই উপত্যকায় কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি। তবে বেসরকারি হিসাবে একজন অভিযাত্রীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ ছাড়াও যে কত প্রাণী এই উপত্যকায় এসে খিদে-তেষ্টায় মৃত্যুবরণ করেছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। সেই পরিসংখ্যান বুকে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে মৃত্যু উপত্যকা। নয়া দিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *