একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বনাম ষোলো শ ভুখা শ্রমিক; ব্যাপারটা এমন সরল নয়। দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্র বনাম শ্রমিকের। দখল করা জমিতে বিজিএমইএর ১৫ তলা ভবন যেভাবে পুলিশ, জলকামান, টিয়ার গ্যাসের মেশিন দিয়ে পাহারা দেওয়া হয়, তেমনি করে অনশনরত শ্রমিকদের ঘেরাও করে রেখেছে শত শত পুলিশ, জলকামান, রায়ট ট্যাংক এবং অবশ্যই লীগ পরিবারের মারদাঙ্গারাও আছে। এসব ভেদ করে গতকাল কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি ঢাকার বাড্ডার তোবা গার্মেন্টসের ভেতরে অনশনরত শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করার। কেবল খোপ খোপ জানালায় দেখা গেছে তাঁদের বিষণ্ন, মলিন না-খাওয়া মুখ। চোখের সামনে দিয়ে কঙ্কালসার এক শ্রমিককে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। তাঁর মুখের দিকে, ঘোলাটে চোখের দিকে তাকানো যায় না। তাকালে মনুষ্যত্বে বিশ্বাস নড়ে যায়।
আসমার মা মেয়ের জন্য পানি নিয়ে এসেছিলেন, মেয়ে ভেতরে অনশন করছেন ঈদের আগের রাত থেকে। তাঁকে মেরে তাড়িয়ে দিলেন শ্রমিক লীগের কিছু লোকজন। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, তঁাদের পাশে শ্রমিকবিরোধী ভূমিকায় নেমেছেন ‘বামপন্থী’ বলে পরিচিত ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারাও। মারকুটেদের সঙ্গে শ্রমিকদের হয়ে তর্ক করছিলেন এক লুঙ্গি পরা বৃদ্ধ। তাঁকেও নির্মমভাবে পেটানো হলো। পুলিশ দেখল। বাম মোর্চার নেতারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশও তাঁদের মারল। বাম মোর্চাভুক্ত গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি আবারও ফিরে এলেন কথা বলতে। পুলিশ তাঁকে মারতে মারতে নিয়ে গেল প্রায় দুই শ গজ দূরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাটকের দল বটতলার শিল্পী ও পরিচালক সামিনা লুৎফা এবং নৃবিজ্ঞানী সায়দিয়া গুলরুখ বসে ছিলেন তোবার গেটের সামনে। তাঁরা দাবি করছিলেন, শ্রমিকদের কাছে স্যালাইন ও ওষুধ পাঠাতে দেওয়া হোক। এই দাবির পুরস্কার হিসেবে এই দুজন নারী, এই দ্ুজন বিদ্বানকে পুলিশ লাঠি-ঘুষি মেরে সরিয়ে দিল রাস্তার ওপারে। সেখানে তাঁদের পেটালেন শ্রমিক লীগের কর্মীরা। এই লেখকেরও রেহাই হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রেও সাংবাদিকেরা যেতে পারেন, কিন্তু পোশাকমালিকের দুর্গে সেই সুযোগ নেই।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দলে দলে পুলিশ ঢুকল কারখানার ভেতরে। জানার উপায় নেই ভেতরে কী হচ্ছে? কিছুক্ষণ পরে অল্প কয়েকজন শ্রমিক ও স্বেচ্ছাসেবককে তারা বের করে আনলেন। একজন চিকিৎসক ঢুকতে চাইলেন, বাধা দেওয়া হলো। সব মিলিয়ে আবেগ, জেদ, অসহায়ত্ব আর নৃশংসতার তীব্র চাপ সবার মনে। আশপাশের বস্তি থেকে যাঁরা দেখতে এসেছেন, তাঁদেরও দাঁড়াতে দেওয়া হলো না। তোবার শ্রমিকদের এখন সবদিক থেকে চেপে ধরে আত্মসমর্পণ করানো হবে। সরকার এর সাক্ষী রাখতে চায় না।
ভেতরের অবস্থা জানা যায় না; শুধু শোনা যায়, শ্রমিকদের স্লোগান আর আহ্বান। পড়া যায় জানালা দিয়ে বাড়িয়ে ধরা হাতে লেখা পোস্টার: ‘হয় বেতন দাও, নইলে মেরে ফেলো’। পুলিশ সহৃদয় জীব। তারা আহ্বানটি শুনেছে। উচ্চমহলের নির্দেশে তারা ভোরবেলাতেই তোবার ফটকে তালা লাগিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য জানালেন, বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে শ্রমিকদের হার মানানোই হলো উদ্দেশ্য। তাই সাংবাদিকেরাও নিষিদ্ধ।
আমাদের পুলিশ অনেক মালিকমনা। বেতন-ভাতার জন্য শ্রমিকেরা রাস্তায় আন্দোলন করলে লাঠি-গুলি চলে, আটক করে নির্যাতন করা হয়। আর যদি শ্রমিকেরা নির্বিবাদে কারখানার ভেতরে অনশন করেন, তখন তাঁদের বলা হয় ‘শিল্পবিরোধী’। তাঁদের সমর্থকদের পেটানো হয়। অনশন চালাতে হলে যে চিকিৎসাসেবা দরকার, স্যালাইন দরকার, পানি দরকার—সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় শ্রমিকদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যু কিংবা পরাজয়বরণের বাইরে আর কিছুই করার থাকে না।
বাংলাদেশে মিনিমাগনায় পাওয়া যায় শ্রমিকদের জীবন। শত থেকে হাজারে হাজারে তাঁরা মারা যান পুড়ে বা থেঁতলে গিয়ে। বিচার হয় না। মাসের পর মাস কাজ করানো হয়, কিন্তু বেতনের নাম নিলেই মালিকপক্ষীয় হাজারো বাহানা। সরকারের দাঁড়ানোর কথা ছিল শ্রমিক ও মালিকের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে, শ্রমের ব্যবস্থাপক হিসেবে। কিন্তু তারা দাঁড়িয়েছে মালিকের পাশে। তাজরীন ফ্যাশনসে সজ্ঞান অবহেলায় ১১১ জন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারা, অজস্রজনের আহত হওয়া এবং পরে আরও কয়েকজনের মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিক দেলোয়ার হোসেনের বিচার হয় না। আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে, তা হত্যার অপরাধে নয়, ক্ষতিপূরণ আদায়ের দায়ে। তোবার ফটক, বিজিএমইএর ফটক, অধিকারের ফটক শ্রমিকদের জন্য খোলা হয় না, কিন্তু ঠিকই দেলোয়ার হোসেনের জন্য জেলের গেট খুলে যায়। তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় সরকার ও সমগ্র মালিকবাহিনী। এবং জেল থেকে বেরিয়েই তাঁর শক্তি দেখালেন তোবার কারখানার সামনে, গত বুধবার। এ ধরনের ব্যক্তি জেলে থাকাই তাই জনস্বার্থে নিরাপদ।
বিজিএমইএ বলছে, দুই মাসের বেতন কারওয়ান বাজারের বিজিএমইএ ভবন থেকে নিয়ে যেতে হবে শ্রমিকদের। যেখানে রানা প্লাজার ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিজিএমইএ ও সরকার ছিনিমিনি খেলেছে, সেখানে শ্রমিকেরা কেন তঁাদের আশ্বাসে আন্দোলনের শক্তি সমর্পণ করবেন? আর বেতন তো তোবার অনশনস্থলে এসেও দেওয়া যায়। মনের মধ্যে কুমতলব যদি না–ই থাকবে, তাহলে এত পুলিশ নিয়েও কিসের ভয়ে তারা ভীত?
শ্রমিকেরা চাইছেন তিন মাসের পুরো বেতন ও ঈদের বোনাস। অনেকে বলবেন, আপাতত মেনে নাও, পরে দেখা যাবে। আসলে পরে দেখার আর সুযোগ নেই। বস্তির ঘরের মালিক তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন, ভাড়া দিতে না পারায় অনেকের গয়না ও আসবাব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনশনের আগের তিন মাস তাঁরা আন্দোলন করেছেন কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি। কেউ কথা শোনেনি। তাঁদের অনশন যে কতটা নিরুপায়, তা বোঝা যায় জরিনা নামের এক শ্রমিকের কথায়। তিনি জানান, ‘ঘরে তালা, সন্তানদের খাবার দিতে পারি না, থাকতে দিতে পারি না। পাওনাদারদের জন্য এলাকায় যেতে পারি না।’ এই অবস্থায় কারও পক্ষেই কায়িক পরিশ্রম ও জীবন কোনোটাই চালানো অসম্ভব। সেই অসম্ভব বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়েই তোবার শ্রমিকেরা আমরণ অনশনে গিয়েছেন।
দুই মাসের বেতনে ধারদেনা শোধ হবে না, দোকানের বাকির খাতাও অটুট থাকবে। এসব ঘাট পার হওয়ার পরও তাঁদের সামনে অপেক্ষা করছে নতুন একটি মাসের হঁা হঁা অভাবের জ্বালামুখ। তাঁদের জন্য সরকার ও মালিকপক্ষ একটা রাস্তাই খোলা রেখেছে, তা হলো মরে যাওয়া। মরারও শর্ত আছে। মরতে হবে দূরে গিয়ে; যেভাবে অসীম কষ্ট পেয়ে নিভৃতে মরে গেছে তাজরীনের কিশোরী শ্রমিক সুমাইয়া। যেমন মরে যাচ্ছেন আরও অনেকে। কত ফুল ফোটে আর ঝরে, কে তা মনে রাখে? এত অন্যায়ে মানুষ বাঁচে না।
মানুষ মরছে সবখানে। বঞ্চনার প্রতিকার দেওয়ার কেউ নেই। বিকেলের দিকে চলে আসার সময় তোবার অবরুদ্ধ ভবনের ভেতর থেকে ভেসে এল এক শ্রমিকের চিৎকার: ‘আমরা আর লাশ হতে চাই না। আমরা সন্ত্রাসী না, আমরা শ্রম দিই, আমরাও মানুষ!’ এই একটি সরল স্বীকৃতি তঁারা চান। দাস নয়, তঁারা চান সরকার তঁাদের মানুষ ভাবুক। এবং এঁরা আর এঁদের পরিবারের জনসংখ্যা কয়েক কোটি!