১৭ সেপ্টেম্বর উদ্যাপিত হয়েছে বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির ৪০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে সরকারি উদ্যোগে কোনো কোনো পত্রিকায় একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ-জাতীয় বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে ক্রোড়পত্র প্রকাশ একটি রেওয়াজও বটে। এতে ঘটনাটির তাৎপর্য তুলে ধরা যায় বিভিন্ন বাণী ও নিবন্ধের মাধ্যমে। তবে আলোচিত ক্রোড়পত্রটিতে কার্যত কোনো নিবন্ধ নেই। লেখকের নামবিহীন কিছুটা আলোচনা রয়েছে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে।
বাণী রয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর। এদিকে একই দিনে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের খবরে জানা গেল, এই ক্রোড়পত্রে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বাণী স্থান পায়নি। বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও সত্য। সেই দৈনিকটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে মহাসচিব প্রেরিত বাণীর একটি অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে উল্লেখ এবং সব পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে এর নিষ্পত্তির আহ্বান জানানো হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানাভাব বা সময়াভাবে এটা বাদ পড়েছে বলা হলেও একে যথার্থ বলে ধরে নেওয়া যায় না। বাণী পাঠাতে মহাসচিবকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বেলা তিনটায় বাণীটি পৌঁছেছে এমনটা বলা হয়। রাত নয়টায় পৌঁছালেও পরের দিনের খবরের কাগজের যেকোনো ক্রোড়পত্রে এর সংযোজন সম্ভব। তবে অপ্রিয় সত্যকে মোকাবিলায় অনীহার কারণে এমনটা ঘটেছে বলে সংগতভাবে ধরে নেওয়া যায়।
বান কি মুন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক। ছিলেন সে দেশের একজন পেশাদার কূটনীতিক। একপর্যায়ে হয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৭১ সালে একজন তরুণ কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন দিল্লিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমাদের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তিপত্রে তিনি তাঁর দেশের পক্ষে সই করেছিলেন। সেই কলমটি তিনি আজও সংরক্ষণ করছেন এমন দাবি বাণীটিতে তিনি করেছেন। এ কথাও সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর একটি আবেগঘন সম্পর্ক রয়েছে। এ আবেগের মূল্যায়ন আমরা করিনি। তাঁর বাণীতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে বাংলাদেশের সাফল্য আর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার স্বীকৃতিও রয়েছে। ক্রোড়পত্রে তাঁর বাণীতে এ বিষয়গুলো এলে এটা আরও সমৃদ্ধ হতো।
অবশ্য ক্রোড়পত্রটিতে বিভিন্নভাবে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় সম্পর্কের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে, সদস্যপদে অন্তর্ভুক্তির অনেক আগে থেকেই জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা ১৯৭১ সালে শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। স্বাধীনতার পরপরই ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএইচও, ডব্লিউএফপি, ইউনিসেফসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা আমাদের জনগণকে সহায়তায় উদারভাবে এগিয়ে আসে। তবে তখনকার বিশ্ব রাজনীতির বৈরী পরিবেশে আমরা সংস্থাটির পূর্ণ সদস্যপদ পেতে স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় লাগে। এ ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সাফল্যের দাবিদার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তখনকার সরকারের সফল কূটনীতি। দুটি বৃহৎ শক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিরোধিতাকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব সংস্থাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের স্থান করে নেয় এর ১৩৬তম সদস্য হিসেবে।
মহাসচিবের যে কয়েকটি মন্তব্যের জন্য তাঁর গোটা বাণীটিই ক্রোড়পত্রে স্থান পেল না, তা তিনি হঠাৎ করে বলছেন না। আর বলছেন না শুধু তিনিই। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে দুটি বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষকে কাছাকাছি এনে একটি অংশগ্রহণমূলক পক্ষপাতহীন নির্বাচনব্যবস্থার প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে মহাসচিব বান কি মুনের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা মূলত কাজ করেছে বলেও জানা যায়। মহাসচিবের বিশেষ দূত তাঁর সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নিবিড় আন্তরিক প্রচেষ্টা আমাদের স্মরণে থাকবে দীর্ঘকাল। তখনকার মতো এটা সফল হয়নি বটে, তবে এর নৈতিক জোর যায়নি তলিয়ে।
এ বছরের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পরে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব একই সুরে একে ত্রুটিপূর্ণ বলছে। এটা ভুলে যাওয়ার নয় যে অধিকাংশ আসনে ভোট গ্রহণের প্রয়োজনই হয়নি। যেখানে তা হয়েছে, সেখানেও ভোটার উপস্থিতি ছিল অতি সামান্য। সবারই পরামর্শ, সব পক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত অধিকরত প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার গঠনের প্রচেষ্টা নেবে। কিন্তু সরকার তার অবস্থানে অনেকটা অবিচল। আর বিরোধী দলও জনমত সংগঠনে তেমন সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে বলে মনে হয় না। তবে এ অবস্থা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিচয় বহন করে না। বরং এ ধরনের পরিস্থিতি অধিকতর অস্থিতিশীলতার কারণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো কোনো বিশেষ বিশেষ মামলার বিষয়ও নজরে রাখবে বলে জানিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য মর্যাদাকর নয়। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, আমরা কিন্তু গত বেশ কিছুকাল পাশ্চাত্য জগতের আবেগ–অনুভূতির প্রতি প্রায়ই উদাসীন থাকছি। কখনো বা করছি বিরূপ মন্তব্য। কেউ কেউ অকারণে তাদের উপেক্ষা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। অথচ আমরা ভুলে যাই, ওরা আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্যের অধিকার দিয়ে রেখেছে আমাদের। গোটা বিশ্ব এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশের পররাষ্ট্রনীতিও অনেকটা অর্থনীতিকেন্দ্রিক হয়। আর আমরা যেন উল্টোটা করতে উঠে-পড়ে লেগেছি।
আলোচিত ক্রোড়পত্রটিতে উল্লেখ রয়েছে যে জাতিসংঘের ২২টি সংস্থা আমাদের দেশে এখন কর্মরত। এর বেশ কটি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২০ হাজার শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ বাহিনীর হয়ে বিভিন্ন সংঘাতময় দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার মাত্র ১৭ বছর পর ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে একটি সামরিক পর্যবেক্ষক দলের সদস্য পাঠানোর মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। আজ অশান্ত পৃথিবীর যেকোনো দিকে দায়িত্ব পালনে নিয়ত সারা দিচ্ছে আমাদের শান্তিরক্ষীরা। নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণে আমরা সম্ভবত শীর্ষস্থানে রয়েছি।
জাতিসংঘকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনায় নিয়ে থাকি। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৪০তম বার্ষিকীতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ ছাড়াও একাধিক অনুষ্ঠান হয়। তারই একটিতে সংস্থাটিকে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন। এর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারপ্রধানেরাই যোগ দিয়ে থাকেন। বিশ্বনেতাদের এই মিলনমেলায় আমাদের অবস্থান ও চাহিদা তুলে ধরার পাশাপাশি সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে অনেক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ ঘটে। বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বে শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের সঙ্গেও সুশীল সমাজের মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ থাকে এ সম্মেলন চলাকালে।
জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৪০ বছর পূর্তি আমাদের জন্য আনন্দ ও গৌরবের। তেমনি এ দেশটির অগ্রযাত্রায় সহযোগী জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো সেই গৌরবের অংশীদার। বিশ্বসমাজের প্রতি জাতিসংঘের মাধ্যমে আমরা শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে যে অবদান রাখছি, তা সংস্থাটির গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়। তা ছাড়া আগে থেকেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী দায়িত্বে আমাদের অনেক মেধাবী ব্যক্তি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এই দিনটি উদ্যাপনে ক্রোড়পত্র প্রকাশ কিংবা এতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বাণী ছাপা আবশ্যক ছিল এমনটা কিন্তু নয়। তবে আমরা নিজ উদ্যোগেই প্রকাশ করেছি ক্রোড়পত্রটি। এতে ছাপার জন্য তাঁর কাছে চেয়েছিলাম একটি বাণী। তিনি পাঠালেনও। কিন্তু একটি কথার সঙ্গে কারও কারও ভিন্নমত থাকায় বাণীটি ছাপা হলো না। হাতে পেয়েও সংস্থার প্রধান নির্বাহীর বাণী আমরা চেপে রাখলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর আবেগঘন সম্পর্ক আমাদের অনেকেরই জানা। গণতন্ত্রের পথে চলতে গিয়ে আমরা হোঁচট খাওয়ায় তিনি বিচলিত। চেষ্টা করেছেন এবং তা অব্যাহত রেখেছেন ক্ষতটিকে সারিয়ে তুলতে। তাঁর সঙ্গে কেউ একমত না–ও হতে পারেন। তবে চেয়ে এনে এটা না ছাপা কতটা সংগত হয়েছে, তা অনেকে বোঝেন বলে মনে হয় না। তাঁর আবেগের প্রতি আমরা যথাযথ সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছি। এ ধরনের আবেগ সর্বক্ষেত্রে অর্থহীন নয়, এটাও আমরা বুঝতে সক্ষম হইনি। প্রকৃতপক্ষে আমরা নিজেদের প্রতিই অবিচার করলাম।