কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ থেকে সুবল চন্দ্র দাস ঃ কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌর শহরের বটতলার অটোগ্যারেজ মালিক মেনু মিয়ার বৈদ্যুতিক মিটারে তিন মাসের বাণিজ্যিক বিল আসে প্রায় ৪১ হাজার টাকা। পিডিবির উপসহকারী প্রকৌশলী নূর ইসলাম তাঁর কাছ থেকে ৪১ হাজার টাকা আদায় করে গ্যারেজে নতুন মিটার লাগিয়ে দেন। পরে একটি ডিমান্ড নোট ধরিয়ে দিয়ে জানান, এখন থেকে নতুন নম্বরেই বিল আসবে। মেনু মিয়া জানান, এর এক সপ্তাহ পর লাইনম্যানরা গ্যারেজের সংযোগ কেটে দেন। এর পরই মেনু মিয়া অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, উপসহকারী প্রকৌশলী তাঁর টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, কেবল মেনু মিয়া নয়, পালানোর আগে একই কায়দায় আরো অন্তত ১৫টি গ্যারেজের বিলের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নূর ইসলাম। পিডিবির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন, উপসহকারী প্রকৌশলী নূর ইসলাম গত ১২ ডিসেম্বর গভীর রাতে সরারচরের বাসার মালামাল নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। অবশ্য এর পরদিনই ১৩ ডিসেম্বর পিডিবির ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী শেখ মো. আলাউদ্দিন দুর্নীতির অভিযোগে নূর ইসলামকে স্ট্যান্ড রিলিজের আদেশ দিয়েছেন। পিডিবির ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী শেখ মো. আলাউদ্দিন জানান, উপসহকারী প্রকৌশলী নূর ইসলামের বির“দ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর তাঁকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে। তাঁর বির“দ্ধে বিভাগীয় ব্যব¯’া নেওয়া হবে। পিডিবির কোনো ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী তাঁকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকলে তিনিও পার পাবেন না। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার গ্রাহকদের লিখিত অভিযোগ দাখিলের পরামর্শ দিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন প্রকল্পের ২৫০ ও ১০০ কেভিএ ক্ষমতার ১০টি বিনা মূল্যে বিতরণের ট্রান্সফরমার ও খুঁটি ওই প্রকৌশলী বিক্রি করে এ খাত থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অটোরাইস, লাকড়ি মিলসহ বিভিন্ন কারখানায় বিল কম করে মাসোহারা নিয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। আবাসিক ও বাণিজ্যিক মিটার পাল্টে দেওয়ার নামেও আত্মসাৎ করেছেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া বহু কলকারখানা, নৌযান তৈরির ডক ও সেচ প্রকল্প চালিয়েছেন মিটারবিহীন। হাটিপাড়ার ফার“ক মিয়া পিডিবির বিদ্যুতে রাইস মিল চালানোর পাশাপাশি অটোগ্যারেজে বাণিজ্যিকভাবে অটোবাইক চার্জ করেন। ফার“ক মিয়ার বিল পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত অক্টোবরে তাঁর হিসাবে ৫০০ ইউনিট গড় বিল করা হয়। বিল আসে তিন হাজার ৯৬৯ টাকা। নূর ইসলাম পালিয়ে যাওয়ার পর একই হিসাবে সাড়ে তিন হাজার ইউনিটের বিল হয় ৩৫ হাজার ৭৯০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, নূর ইসলাম ফার“কের কাছ থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা করে নিতেন। সরারচরের র“হুল আমিন মোল্লা ও বাজিতপুরের বিধুভূষণ বসাকের দুটি মিটার বদলানোর অজুহাতে নূর ইসলাম দ্বিগুণ বিল করেন। পরে বিধুভূষণের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁর বিল থেকে তিন হাজার ইউনিট বাদ দিয়ে বিল করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরারচর বাজারের মোবারক হোসেনের দুটি অটোগ্যারেজে প্রতি রাতে গড়ে ৩৫টি ইজিবাইক চার্জ দেওয়া হয়। সে হিসাবে এক রাতেই তাঁর প্রায় ৩৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার টাকা হিসাবে মাসে এক লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি বিল হওয়ার কথা। কিš‘ গত সেপ্টেম্বরে মোবারকের গ্যারেজে মাত্র ১০ ইউনিট বিল করা হয়। যার মূল্য মাত্র ১১০ টাকা। উপজেলায় ৩০টির মতো অটোগ্যারেজের (ইজিবাইক চার্জ করার ঘর) মধ্যে প্রায় ২০টিই মাসোহারার বিনিময়ে চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নূর ইসলাম বিদ্যুতের নতুন লাইন বসানোর জন্য নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প দাখিল বা অনুমোদন ছাড়াই ঘাগটিয়া মাসকান্দা গ্রামে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, আরসিসি পিলার ও নতুন কপার তার দিয়ে সংযোগের আশ্বাস দিয়ে গ্রামবাসীর কাছ থেকে নূর ইসলাম চার লাখ টাকা নিয়েছেন। কিš‘ পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে বাঁশের খুঁটি ও নিম্নমানের তার। প্রসঙ্গত, নূর ইসলামের আগে বাজিতপুরের তৎকালীন আবাসিক প্রকৌশলী সুনীল সাহাও প্রকল্প দাখিল ও অনুমোদন ছাড়াই উপজেলায় ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ অবৈধ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন দিয়েছিলেন। তিনি ১২ ভাগে উপজেলার ২৫-৩০টি গ্রামে ওই সব লাইন দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সরারচরের শ্যামা অটোরাইস মিলের মালিক অজিত সাহা জানান, বিশেষ কারণে তিনি টানা তিন মাস মিল বন্ধ রাখেন। এ অব¯’ায় নূর ইসলাম তাঁর কাছে এক লাখ টাকা ঘুষ চান। টাকা না দেওয়ায় তাঁর মিলের অনুকূলে তিন লাখ টাকা বিল করা হয়। এদিকে নূর ইসলাম বাজিতপুর বাজারের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবসায়ী আবদুল কাদির ও কাউসারের সেচ প্রকল্প চালাতে দুটি ট্রান্সফরমার দিয়ে দেন। দুটি ট্রান্সফরমারই নতুন প্রকল্পের খুঁটি দিয়ে বসানো হয়। এ ক্ষেত্রে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পিডিবির অভিযুক্ত উপসহকারী প্রকৌশলী নূর ইসলাম জানান, তিনি গভীর রাতে নয়, বাসার মালামাল নিয়ে সেদিন ভোরবেলা বাজিতপুর ছেড়েছেন। কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গ তুলতেই বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বাবা! এ তো অসম্ভব ব্যাপার!’ দুর্নীতির অভিযোগে স্ট্যান্ড রিলিজের বিষয়টি কেউ নাকি তাঁকে জানায়নি। তবে তাঁর বির“দ্ধে গ্রাহকরা কী কী অভিযোগ করছে, তিনি নিজে তা জানার চেষ্টা করছেন। নির্বাহী প্রকৌশলীকে আত্মীয় অস্বীকার করে তিনি জানান, উপসহকারী হয়ে আবাসিক প্রকৌশলীর প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই।