জিসান আহমেদ, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি ১২.০১.২০১৫): “গাছে ফল ধরেছে/লোকের নজর পড়েছে/হায়রে কাঁচা এ ফল ওরা বুঝি পাঁকতে দেবে না/আমি বেড়া দিয়েছি/বাগান আগলে রেখেছি/যতো চেংড়াছোড়া শান্তিতে আর থাকতে দেবে না।”- এ গানটির সময় ৪ মিনিট ৪ সেকেন্ড। গানের শুরুতেই লিমা নামের ১৮-১৯ বছরের সস্তা মেকাপে এক যুবতি মঞ্চে এসে নাচ শুরু করলো। গানের এক মিনিট অতিবাহিত হবার পরই মঞ্চে নাচরত যুবতিটি নিজ শরিরীরে পোষাক একে একে খুলতে শুরু করে। গানের ৩ মিনিটের মাথায় তার শরিরের সমস্ত পোষাক খুলে একেবারে উলঙ্গ নাচ করতে থাকে যুবতিটি। একই সঙ্গে উপ¯ি’ত দর্শকও মত্ত হয়ে ওই যুবতির নাচের তালেতালে নাচতে শুরু করলো। গানের শেষে যুবতিটি উলঙ্গ অব¯’ায় মঞ্চ থেকে নেমে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো দর্শকদের চিৎকার “আবারো তাদের ওই নাচ চাই”। শুরু হলো দ্বিতীয় গান। আবারও একই দৃশ্য। দৃশ্যটা শনিবার রাত ১ টার সময় চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মনোহরপুর শিমুলতলার বিজয় মেলার যাদু প্রদর্শনী মঞ্চের। এ দৃশ্যটা শুধু একদিনের নয়; জীবননগর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে বিজয় মেলার নামে এ ধরনের বেসামাল উলঙ্গনাচ-গান আর জুয়া চলছে ১১দিন ধরে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকেই ফড়গুটি, লাখী কুপন, র্যাফেল ড্র, ওয়ানটেন ও হাউজি ব্যাম্পারসহ চলছে লাখ লাখ টাকার রমরমা জুয়ার আসর। উঠতি বয়সী কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী আর গ্রাম্য যুবকের আড্ডায় জমে ওঠা গভীর রাত পর্যন্ত মনোহরপুর গ্রামের বিজয় মেলা প্রাঙ্গন এখন শুধুই অশ্লি¬¬¬লতার আগ্রাসন। সরেজমিন বিজয় মেলা ঘুরে দেখা গেছে এসব দৃশ্য। বিজয় মেলার নামে সমাজবিরোধী এ কাজ পরিচালিত হলেও নগদ নারায়নে তুষ্ট প্রশাসন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিজয় মেলার নামে নিয়মিত রাতের আঁধারে উলঙ্গ নাচ আর লাখ লাখ টাকার জুয়ার আসর চলছে প্রশাসনকে সš‘ষ্ট করেই। এছাড়া এলাকায় ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে, চুয়াডাঙ্গার ¯’ানীয় পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক ও তাদের নিয়োগ দেয়া কিছু চাঁদাবাজ সাংবাদিক নির্বিঘেœ মেলা চালানোর সার্বিক সহযোগিতা করার ব্যাপারে মেলার আয়োজকদের কাছ থেকে প্রতিরাতে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নি”েছ।
গত ১ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘটা করে মেলা উদ্বোধন করা হয় উলঙ্গ নাচ ও জুয়ার আসর বৈধ করার জন্য। প্রতিদিন সকাল থেকে এলাকায় মাইকিং করে র্যাফেল ড্রর প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখলেও মূলত যাদু প্রদর্শনীর নামে সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় উলঙ্গনাচ। এর ফলে এলাকার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া লাটে উঠেছে। যুব সমাজকে গ্রাস করছে অবক্ষয়ের নীল ছোবল।
চুয়াডাঙ্গার উথলী ইউনিয়ন যুবলীগের কথিত নেতা রেজাউল হক বলেন, বিচিত্রা অনুষ্ঠানের কথা না বললে মেলার প্রশাসনিক অনুমতি মেলেনা। এজন্য প্রশাসনকে নিয়মিত টাকা দিয়ে যাদু প্রদর্শনীর নামে উলঙ্গনাচ ও লাখ লাখ টাকার জুয়া ও লটারী খেলা চালানো হ”েছ। তা না হলে পোষাবে কি করে ? প্রশাসনকে সš‘ষ্ট করতে তাদের চাহিদা মত অনেক টাকা গুনতে হয়। আগে তাদের নগদ টাকা দিয়ে তার পর অনুমতি নিতে হয়। তিনি আরো জানান, উথলী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন খান ওরফে ছইরদ্দিনের হাত দিয়ে মেলা সংক্রান্ত টাকা লেনদেন হয়েছে। সেই মেলা পরিচালনার নেপথ্যের মূল হোতা। এ ব্যাপারে ছইরদ্দিন বলেন, এ গুলো মিথ্যা কথা। আমি মেলার বিষয়ে কিছুই জানিনা।
এলাকাবাসীর পক্ষে উথলী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য খলিলুর রহমান জানায়, বিজয় মেলায় অশ্লি¬লতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ায় একদিকে যেমন বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তী নষ্ট হ”েছ, তেমনি এলাকার উঠতি বয়সী যুবসমাজ হ”েছ বিপথগামী। এছাড়া মেলার কারণে এলাকার আইন-শৃঙ্খলারও চরম অবনতি হয়েছে এবং জুয়াড়িরা মেলায় এসে নিঃস্ব হয়ে চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান সোমবার চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যব¯’া গ্রহনের জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজী আলী আজগার টগর, মহা-পুলিশ পরিদর্শক, বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার, র্যাব-৬ অধিনায়ক, চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার, জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জীবননগর থানার অফিসার ইনচার্জকে অভিযোগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিš‘ তার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে উলঙ্গনাচ ও জুয়া বন্ধের ব্যাপাওে কোন কার্যকরী ব্যব¯’া গ্রহন করা হয়নি।
মনোহরপুর শিমুলতলায় মেলা প্রসঙ্গে জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাফিজ বলেন, তাকে জানিয়ে এ মেলার অনুমতি দেয়া হয়নি। বিধায় তার পক্ষে মেলা সংক্রান্ত খোঁজ রাখা সম্ভব হ”েছ না। তিনি এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আনজুম আরার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দেন। ম্যাজিষ্ট্রেট আনজুম আরার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মেলা চালানোর দিন বাড়ানো হয়েছে ঠিকই। কিš‘ উলঙ্গনাচ, জুয়া, ফড়গুটি ইত্যাদি চললে অবশ্যই এ মেলা বন্ধ হয়ে যাবে। নিয়মের বাইরে গিয়ে কাউকে মেলা চালাতে দেয়া যাবে না।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাফিজ আজ রবিবার রাত ১১টার দিকে জানান, মনোহরপুর শিমুলতলার মেলা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। ওরা আস্তে আস্তে সব সোমবারের মধ্যেই সরিয়ে নেবে। এরপর মেলার আয়োজক রেজাউল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসাইনের ঐ”িছক তহবিলে অনেক টাকা জমা দিয়ে মেলা চালু রাখার অনুমতি নিয়েছি। আমরা সোমবার মেলা সরাবো না। যতদিন আমাদের অনুমতি আছে ততদিন মেলা চালাবো।
প্রসঙ্গত, জীবননগর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের মিতালী যুব সংঘের সভাপতি ও কথিত উথলী ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য রেজাউল হক ( চোরাকারবারী ) বিজয় মেলার নামে যাত্রা ও সার্কাস চালানোর অনুমতির জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৩০ ডিসেম্বর’১৪ হতে ৮ জানুয়ারী’১৫ পর্যন্ত শুধু সার্কাসের অনুমোতি দেয়া হয়। কিš‘ গত ১ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার থেকে মেলার মাঠে সার্কাসের পরিবর্তে অবৈধভাবে উলঙ্গনাচ, ফড়গুটি, লাখী কুপন, র্যাফেল ড্র, ওয়ানটেন ও হাউজি ব্যাম্পারসহ বিভিন্ন জোয়ার আসর বসানো হয়েছে।