আবারও বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে চাপাতি। বুধবার রাতে নাজিমুদ্দিন সামাদকে ঘিরে ধরে একদোল লোক। ২৮ বছর বয়সী সামাদ ছিলেন আইনের শিক্ষার্থী। ওই লোকেরা তার মাথায় কোপানো শুরু করে। এরপর গুলি করে হত্যা করে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। কেউ দায়ও স্বীকার করেনি।
সামাদ নিয়মিতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালিখি করতেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য প্রচারণা চালাতেন। ধর্মের সমালোচনা করতেন। এছাড়া শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তার। এ আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের মৃত্যুদ- সহ কঠোর শাস্তির দাবি উঠেছিল।
২০১৩ সাল থেকে সাত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ লেখক, ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টকে খুন করা হয়েছে বাংলাদেশকে। আরও সাত জনের ওপর হামলা হয়েছে। কিছু ঘটনায় একটি জঙ্গিগোষ্ঠী দায় স্বীকার করেছে। সরকারের পদক্ষেপ ছিল বাজে ও অপর্যাপ্ত। কর্তৃপক্ষ কিছু গ্রেপ্তার অবশ্য করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার ব্লগারদের সতর্ক করে দিয়েছে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে লেখালিখি না করার জন্য। এমনকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে কয়েকজন ব্লগারের বিচারও করেছে রাষ্ট্র। এছাড়া বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তচিন্তকের ‘হিটলিস্ট’ বাংলাদেশে প্রচার হয়েছে। অনেক ব্লগার বিদেশে আশ্রয় চেয়েছে।
গত সপ্তাহে, প্যারিসে একটি সম্মেলনে নির্বাসিত লেখক ও তাদের সমর্থকরা জড়ো হন। সেখানে আমি কয়েকজন বাংলাদেশী ব্লগারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, যারা এখন বিদেশে বসবাস করেন। একজনকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছিল। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। বাকিরা কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এ সাহসী লেখকদের নিজ দেশে নির্ভয়ে ও মুক্তভাবে কাজ করতে দেয়া উচিৎ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার সবচেয়ে মৌলিক দায়িত্ব পালনেই ব্যর্থ হয়েছে।
নিজের ফেসবুক পেইজে, সামাদ ধর্মকে ক্ষমতাশালীদের জন্য নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইসলামকে দেশের রাষ্ট্রধর্ম থেকে সরানোরও আহ্বান জানিয়েছেন। বৃটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফকে তার এক বন্ধু বলেন, গত বছর সিলেটে সামাদের ওপর হামলা হয়। সেখানে অনন্ত বিজয় দাস হত্যার পরপরই ওই হামলা হয়।
এসব হত্যাকা- এমন এক ধারার অংশ যা বাংলাদেশের জন্মের সময়কার এক অমীমাংসিত ভয়ানক কাহিনীর ফলাফল। এক দিকে, ধর্মীয় মৌলবাদী ও নাস্তিক বা নিজেদের মুক্তচিন্তক দাবি করা লেখকদের মধ্যে এটি একটি সংঘাত। এটি আবার মৌলবাদী ও এর বিরোধীদের মধ্যকার আরও বড় একটি বিরোধের অংশ। নিহত অনেক লেখকদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে মুক্তমনা ব্লগে। অতীতে এটি ফরাসি ম্যাগাজিন চার্লি এবদোর প্রশংসা করেছে।
কিন্তু এ সংঘাতে বাংলাদেশের আরও দুইটি উত্তেজনা ভ’মিকা রেখেছে। একটি হলো, রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশ কি মুসলমানদের দেশ নাকি বাংলাভাষীদের দেশ? ১৯৭১-এ স্বপ্ন ছিল প্রথাভাঙ্গা অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্র সৃষ্টির। ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তানের অংশ ছিল বাংলাদেশ। এই পাকিস্তানই বাঙ্গালি পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় চাপিয়ে দেয় বাসিন্দাদের ওপর।
আরেকটি সংঘাত হলো অতীর অপরাধের বিচার নিয়ে। ১৯৭১ সালে জঘন্য অপরাধে জড়িতদের কি বিচার করা উচিৎ? নাকি তাদের দ-মুক্তি দেয়া উচিৎ?
প্রাথমিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাই বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার পরই দেশটিতে কয়েকটি অভ্যুত্থান ঘটে। সংবিধান পালটে যায়। এক পর্যায়ে ইসলামকে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। যুদ্ধাপরাধে জড়িত সন্দেহে অনেকেই তখন শাস্তি এড়ায়। অনেককে মন্ত্রীত্বের পদে বসানো হয়। কিন্তু এখনকার সরকার অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনছে।
সব নিহত ব্লগার ও প্রকাশক ইসলামি রাষ্ট্র সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। তারা এক হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল।
অনেক বাংলাদেশী, যাদের অনেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান, তারা ১৯৭১ সালের নির্যাতনের বিচার চান। দেশের প্রতিটি জেলায় অনেক পরিবার আছে, যারা ১৯৭১ সালে নিজেদের প্রিয় কাউকে হারিয়েছেন। আছে নারী, যারা ধর্ষিত হয়েছেন। আছেন অনেক মানুষ যাদের জীবন ধর্মের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। এরা সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠেন যখন দেখেন, ওই অপরাধে জড়িতরা বিচার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। তারা স্বাভাবিকভাবেই চান ট্রাইবুনাল তাদের কাজ করুক।
এটাও নিশ্চিত, ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এসবের সমালোচনা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব ত্রুটি বেশ মারাÍকও। একটি ক্ষেত্রে, এক বিচারককে সরে যেতে হয়েছিল। কঠোর শাস্তির পক্ষে প্রচারণারত এক ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শরত অবস্থায় ওই বিচারকের কথোপকথনের রেকর্ডিং ফাঁস হয়েছিল। অনেকক্ষেত্রে স্বাক্ষীরা বিরুদ্ধে চলে যায়! প্রমাণের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যও আছে।
মৌলবাদীরাও ক্ষুদ্ধ। তারা তাদের প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে চায়। ব্লগারদের মতো অনেক বাংলাদেশীও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে চান। তারা চান সরকার আরও দৃঢ়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে থাকুক। বিচারের প্রকৃতি, ধর্মের ভ’মিকা ও জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি Ñ এ তিনটি ভিন্ন ধরণের আখ্যান এক প্রাণঘাতী মিলনবিন্দু সৃষ্টি করেছে। এ ধরণের পরিবর্তনশীল পরিবেশে, সরকার লেখকদের সুরক্ষা দিতে কিংবা চাপাতি থামাতে ব্যর্থ।
[সলিল ত্রিপাটি পেন ইন্টারন্যাশনালের ‘রাইটার্স-ইন-প্রিজন কমিটি’র চেয়ার। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তার বই ‘দ্য কর্নেল হু উড নট রিপেন্ট’ ইয়েল থেকে প্রকাশিত হবে এ মাসে। উপরের লেখাটি ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ।]