শুক্রবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলিউড অভিনেতা ওম পুরি। মুম্বাইয়ে তার নিজ বাসভবনে মৃত্যু বড়ন করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
আর চলচ্চিত্র পরিচালক খালেদ কিদওয়াই বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন কীভাবে কেটেছিল ওম পুরির শেষ সন্ধ্যা।
১৯৫০ সালে হরিয়ানার আম্বালায় এক হিন্দু-পাঞ্জাবী পরিবারে জন্ম হয় ওম পুরীর। তার বাবা ভারতীয় রেল আর তার আগে সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন।
হিন্দি ছাড়াও অনেক ভারতীয় ভাষা এবং ব্রিটিশ ও হলিউডি ছবির সঙ্গে পাকিস্তানের ছবিতেও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চার দশক ধরে অভিনয় করেছেন মি. পুরী।
দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা আর তার পরে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করেন ওম পুরী।
দিল্লির এনএসডি-তে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ ছিলেন ওম পুরীর সহপাঠী। সেই সময়ে খুব কম অভিনেতারই নাট্য-অভিনয়ের প্রথাগত শিক্ষা বা ডিগ্রি ছিল।
১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ওম পুরী। ‘ঘাঁসিরাম কোতোয়াল’ নামের মারাঠি ভাষায় তৈরি ছবিটি-ই তাঁর অভিনয় করা প্রথম চলচ্চিত্র।
তার পরের চল্লিশ বছরে ‘অর্ধ-সত্য’, ‘সদগতি’, ‘আস্থা’, ‘আক্রোশ’, ‘মির্চ মসালা’, ‘জেনেসিস’ বা ‘ধারাভী’র মতো সমান্তরাল ছবিতে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনই বহু হিট বলিউডি বাণিজ্যিক ছবিতেও একই রকম স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন তিনি।
‘ডিস্কো ড্যান্সার’ থেকে শুরু করে ‘চাচী ৪২০’, ‘চায়না গেট’, ‘হেরাফেরি’, ‘মালামাল উইকলি’, ‘ রঙ দে বাসান্তি’, ‘দাবাং’- এর মতো জনপ্রিয় ছবিতেও তাঁকে দেখা গেছে নানা ধরণের চরিত্রে।
নিজের মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলেছিলেন ২০১৫ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে। সে বছর মার্চ মাসে তিনি বলেছিলেন ঘুমের মধ্যেই হয়তো মৃত্যু আসবে তার।
‘মৃত্যুটা তো বুঝতেই পারে না কেউ। ঘুমের মধ্যেই হয়তো চলে যাব। আপনারা হয়তো জানতে পারবেন সকাল সাতটা বাইশ মিনিটে ওম পুরী মারা গেছেন’। কথাগুলো বলেই হেসে ফেলেছিলেন ওম পুরী। ঘটনাচক্রে তাঁর মৃত্যু অনেকটা সেভাবেই হয়েছে।
তার কথায়, ‘মৃত্যুর ভয় নেই। অসুস্থ হয়ে পড়াটা আরও ভয়ের। যখন দেখি মানুষ অসুস্থ হয়ে গিয়ে চলাফেরা করতে পারে না, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে – আমার সেটাতেই বড় ভয়।’
বিভিন্ন রকম চরিত্রে সচ্ছন্দ্য অভিনয় দক্ষতা আর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর – এই দুটোই ছিল ওম পুরীর মূল সম্পদ।
সেজন্যই গোটা মুখে বসন্তের দাগ থাকা স্বত্ত্বেও তাকে সত্যজিৎ রায়, গোবিন্দ নিহালনী, শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষরা যেমন নিজের ছবির জন্য ডেকেছেন, তেমনই ডেকে নিয়েছেন ‘গান্ধী’ ছবির জন্য রিচার্ড অ্যাটেনবরো বা ‘সিটি অব জয়ে’র পরিচালক রোল্যান্ড জফ।
রাজকুমার সন্তোষী, কমল হাসান, সুভাষ ঘাই বা প্রিয়দর্শনের মতো জনপ্রিয় হিন্দি ছবির পরিচালকরাও তাকে রেখেছেন নিজেদের হিট ছবিগুলোতে।
আবার ‘ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট’ বা ‘ইস্ট ইজ ইস্ট’-এর মতো আন্তর্জাতিক ছবিতেও কাজ করেছেন ওম পুরী। বিবিসি-র টেলিভিশন নাটক ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’এও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
চলচ্চিত্র পরিচালক খালেদ কিদওয়াই বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত ওম পুরির শেষ সন্ধায় তিনিই ছিলেন অভিনেতার সঙ্গে।
পুরীর ফ্ল্যাটে বিকেলে গিয়েছিলেন কিদওয়াই। সেখানে কিছু কাজ সেরে একটি অনুষ্ঠানে এক সঙ্গেই গিয়েছিলেন দুজনে। নিজের গাড়িতেই ওম পুরিকে নিয়ে গিয়েছিলেন কিদওয়াই।
সেখানে হাজির অন্য কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করতে করতেই একটু মাথা গরম করে সেই বাড়ি থেকে কিদওয়াইকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যান ওম পুরি। মাঝে হঠাৎই তার ইচ্ছে হয় ছেলে ঈশান্তের সঙ্গে দেখা করার। পুরির দ্বিতীয় স্ত্রী ছেলে ঈশান্তকে নিয়ে আলাদাই থাকেন।
ছেলের ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছে ঈশান্তকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলেন ওম পুরি। ছেলে ততক্ষণে সেই অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিল, যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে রাগ করে বেরিয়ে এসেছেন ওম পুরি।
কিদওয়াই বলছেন, ‘বেশ ইমোশানাল হয়ে পড়েছিলেন ওম পুরি। বেশ পানও করেছিলেন তিনি। ওই ফ্ল্যাটে গিয়েও আরও এক পাত্র পানীয় ঢেলে নেন নিজের জন্য। বারণ করেছিলাম আমি, কিন্তু উনি বললেন ছেলে ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এটা খাব। ততক্ষণে যদি ও না ফেরে, তাহলে চলে যাব বাড়ি।
‘রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত ছেলে ওই পার্টি থেকে আসে নি। তখন মি. পুরিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, বলি যে চলুন এবার রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া যাক। উনাকে বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেই যখন, তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।’
নিজের বাড়ীতে ফিরে গাড়ি পার্ক করার সময়ে কিদওয়াই খেয়াল করেন যে ওম পুরী নিজের টাকার পার্সটা গাড়িতেই ফেলে গেছেন। অত রাতে আর ফোন করে বিরক্ত করেন নি অভিনেতাকে।
‘আজ সকালে সাড়ে ছটায় ফোন করেছিলাম। কিন্তু কেউ ফোন তোলে নি। ভিসা নেওয়ার জন্য যে উনি দূতাবাসে যাবেন নটায়। তাই উনার গাড়িচালককে ফোন করি আমি। সে জানায় সকাল সাতটায় ওম পুরির ফ্ল্যাটে পৌঁছে যাবে সে। আর যাওয়ার পথে আমার এখান থেকে ঘুরে যাবে, টাকার পার্সটা নিয়ে নেবে সে। আমি তারপরে জেগেই ছিলাম। সকাল আটটা নাগাদ গাড়ির চালকের ফোন পাই। তখনই খবরটা জানতে পারলাম’। বলছিলেন খালেদ কিদওয়াই।