গল্পটা কারওয়ান বাজারের, গল্পটা খেটে খাওয়া মানুষের। আমরা যেমন দিনের শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাই , কিন্তু কারওয়ান বাজারের পরিবেশ ভিন্ন কথা বলে। গোটা শহর যেভাবে জেগে ওঠে কিংবা ঘুমুতে যায়, কারওয়ান বাজার চলে তার ঠিক উল্টো রীতিতে। কারওয়ান বাজারের ঘুম ভাঙে সকালে নয়, সন্ধ্যার পর। সবাই যখন কাজ-আড্ডা-সুরাপান ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের রুটিন ‘ফিল-আপ’ করে ক্লান্ত শরীরে দ্রুত নিজের ‘সুইট-হোম’ লক্ষ করে ছুটতে থাকে, কারওয়ান বাজার তখন চোখ কচলাতে কচলাতে টুথব্রাশ খোঁজে— ঠিক এ রকমই ব্যাপারটা। তাই কারওয়ান বাজারের সকাল বলতে আমাদের-আপনাদের সকাল নয়, এখানে সকাল হয় রাত ৯টা, সাড়ে ৯টা অথবা সাড়ে ৮টায়…
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭০০ শতাব্দী থেকেই এখানে বাজার ছিল। ১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিকে কারওয়ান সিং নামের একজন মারোয়ারি ব্যবসায়ী এখানে প্রথম পাইকারি বেচাকেনার একটি মার্কেট খোলেন। তার নামেই এ বাজারের নামকরণ হয়েছে। এখন অবশ্য পাইকারি বাজারের খোলস ছেড়ে বের হয়ে এ এলাকা ‘মিডিয়া পাড়া’খ্যাতি লাভ করেছে। গত দুই দশকে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক গণমাধ্যমের কার্যালয়। কারওয়ান বাজার, বাজারের নামেই এলাকার পরিচয়। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি ও খুচরা বাজার। বিশাল-বিস্তৃত টিনশেড মার্কেট, তার নিচে সারি সারি আড়তঘর। প্রতিটি আড়তের এক কোণে লোহার মই বেয়ে উপরে উঠে গেলেই কাঠের পাটাতন বিছানো ঘুমানোর জায়গা। আড়তের কর্মচারীরা সেখানে ঘুমান। সন্ধ্যার পরপর কেউ কেউ উঠে পড়েছেন ঘুম থেকে, বাকিদের ডেকে তোলা হচ্ছে এখন। একে একে মই বেয়ে কাঁধে গামছা আর লুঙ্গি পরে অনেকটা পিপীলিকার মতো নেমে আসছেন আড়তের কর্মচারীরা। মালিক চলে আসবেন আরেকটু পরেই, এই বড়জোর ঘণ্টাখানেক। এর মধ্যেই গোসল সেরে খেয়ে এসে বসতে হবে আড়তে। বাজারের গোসলখানাগুলোয় তখন শুধুই পানির ঝুপঝাপ শব্দ, কেউ কেউ আবার টয়লেটের দরজায় বদনা হাতে দাঁড়িয়ে খিস্তি-খেউড় করে বাজার মাথায় তুলে ফেলছেন। আশপাশের সস্তা মেস আর হোটেলগুলোয় ২০-৩০ টাকায় সারা দিন ঘুমিয়ে গুটি গুটি পায়ে ভ্যানস্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছে একদল মানুষ। একজন একজন করে আসতে আসতে প্রায় শ’তিনেক মানুষ, এরা সবাই ভ্যানচালক। এই ভ্যান আবার একটু ভিন্ন প্রকৃতির, না আছে প্যাডেল, না আছে সিট কিংবা বেল। এমনকি চাকায় হাওয়াও রয়েছে খুবই অল্প। কেবল মালপত্রবোঝাই করে টেনে নেয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই। গত রাতে যাদের ভ্যানগাড়ি অন্যগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে স্পোক কেটে চাকা টাল হয়ে গেছে, তারা একটু আগেভাগে এসে সেগুলোর মেরামতে হাত লাগিয়েছেন। বাকিরা বিড়ি ফুঁকছেন আর আড্ডা দিচ্ছেন। অধিকাংশেরই আড্ডার বিষয় রাজনীতি। কেউ কেউ আবার ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়েও চিন্তিত। প্রত্যেকেই অপেক্ষায় আছেন আরেকটু পর নিজ নিজ ভ্যান নিয়ে বের হয়ে প্রতিদিনের মতোই জীবন বাজি রেখে পাল্লা দেয়ার জন্য।
প্রতিটি আড়তের ওপর সাদা ধবধবে এনার্জি-সেভিং লাইট জ্বলে উঠেছে। পুরো বাজার ম-ম করছে আগরবাতির গন্ধে। গন্ধটাই বলে দিচ্ছে যে মহাজনদের পা পড়েছে ঘরগুলোয়। আড়তের মালিকরা এখানে পরিচিত মহাজন নামে। কর্মচারীদের কেউ কেউ দুধজল ছিটিয়ে সংস্কারের পবিত্রতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিজেদের আড়তে, কেউবা ঝাড়ু দিয়ে আগের রাতের শেষ আবর্জনাটুকু সরিয়ে দিচ্ছেন, দু-একজন আবার গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন মালপত্র আসার অপেক্ষায়। ভ্যানগুলো সব নেমে গেছে আদিম প্রতিযোগিতায়। এ প্রতিযোগিতাকে যুদ্ধ বলাই শ্রেয়। সবাই নিজের ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পথের ধারে। একটা ট্রাক ঢুকছে তো পড়িমরি করে যে যার ভ্যান নিয়ে জীবনপণ দৌড়। যে আগে ট্রাকের গায়ে ভ্যান ঠেকাতে পারবেন, তিনিই ট্রাকের বস্তা ভ্যানে তুলতে পারবেন। আর এটা না পারলে খাওয়া-ঘুম-বিড়ি-সিগারেট সব বন্ধ। সবজি-ফলমূল-মাছ-পান-সুপারি এ রকম হাজারো আইটেম নিয়ে একে একে বড়-ছোট ট্রাক ঢুকছে পেট্রোবাংলা-টিসিবি-প্রথম আলো-এটিএন নিউজ-এফডিসি রেলক্রসিং হয়ে। মাছের পাইকারি বাজারটা অবশ্য একটু বাইরের দিকে, ওই এফডিসি রেলক্রসিংয়ের কাছে। একে একে বস্তা নামছে ট্রাক থেকে ভ্যানে, ভ্যান থেকে একটু ভেতরের আড়তে। পুরোপুরি জেগে উঠেছে কারওয়ান বাজার। তিতাস কিংবা বিডিবিএল ভবনের ছাদ থেকে সোজা তাকালে মনে হয় যেন মাথার ওপর বিশাল এক আকাশ অন্ধকার নিয়েও আলো জ্বেলেছে কোটি জোনাকি। তখনো কিন্তু একটা দল ঘুমিয়েই আছে। তারা উঠবেন আরো ঘণ্টা দুয়েক পর, যখন পাইকারি ক্রেতারা এসে যে যার মালপত্র কিনে আড়ত থেকে রিকশায় তুলবেন। বলছি সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট অবধি পথের ধারে ফুটপাতে ঝুড়ির ভেতর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকা শত শত কুলির কথা। এদের ঘুম ভাঙবে ভোররাতে, তার আগে নয়।
নিত্যদিনের এ দিনলিপির বাইরেও চলে আরো অনেক কাজ, অনেক খেলা, অনেক লীলা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকা অংশও আছে এ বাজারে— রেললাইন। প্রতিক্ষণ, প্রতিমূহূর্ত এ রেললাইনে চলে নেশার বেচাকেনা, এক মুহূর্তের জন্যও তা স্তব্ধ হয় না। সেই সঙ্গে একই তালে জেগে থাকে ওই রেললাইনটি ঘিরে তেজগাঁও আর শিল্পাঞ্চল এই দুই থানার পুলিশ সদস্যদের ‘অর্থমুখী’ চোর-পুলিশ খেলা; তাতে লাভ হয় চোর-পুলিশ তথা মাদকবিক্রেতা-পুলিশ উভয় পক্ষেরই। যা যায় সবটুকুই খুচরা নেশাদ্রব্য ক্রেতাদের পকেট থেকে।এরই মধ্যে দিন-রাত চলে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বৈধ-অবৈধ-উপবৈধ চাঁদাবাজি, চলে ফর্মা অর্থাত্ ইনফর্মার মহাশয়দের ফাঁপরবাজি। আরো চলে ছিঁচকে চোর আর খুচরো ঠকবাজদের ফন্দি-ফিকির। এরই মধ্যে হয়তো রেললাইনে কাটা পড়েছে কোনো এক রুস্তমের ছোট ছেলেটা কিংবা রহিমার বৃদ্ধা মা; মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে নিয়ে সবাই ছুটছেন হাসপাতালের দিকে। সবকিছুই চলছে, ঘুরছে, ছুটছে যে যার মতো। কেবল যেমন ছিল, ঠিক তেমনই একই রূপে দুই যুগ ধরে ক্ষমতাহীন পিতার মতো ভাব নিয়ে পরিবর্তনহীন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ‘জনতা টাওয়ার’। যাকে কারওয়ান বাজারের লোকরা এখনো ‘এরশাদ বিল্ডিং’ নামে ডাকেন নির্দ্বিধায়।
আমাদের স্বদেশ পরিবারের স্বদেশ ভাবনার এবারের উপস্থাপনা ছিল কারওয়ান বাজারের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা সবার কাছে তুলে ধরা, পরিবারের সদস্যদের অন্ন সংস্থানের জন্য উদয়াস্ত সংগ্রাম করেন তারা। এইসব খেটে খাওয়া ও সুবিধা বঞ্ছিত দের নিয়ে স্বদেশ পরিবার বরাবরের মতই স্বদেশ ভাবনা টিম নিয়ে আরজে সাইমুর উপস্থিত হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। স্বদেশের সংবাদ কর্মীরা সেখান থেকে তাদের জীবন যাত্রা মধ্যরাতের কর্মবাসস্ততার চিত্র সরাসরি রেডিও স্বদেশের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ এ সম্প্রচার করেন।