গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল এক বছর আগে। পরিকল্পনা অনুযায়ী চার হত্যাকারী কিলিং মিশনে অংশ নেয়। লিটন হত্যা পরিকল্পনার ‘মাস্টার মাইন্ড’ জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) ডা. আবদুল কাদের খান। ওই আসনের সাবেক এমপি কাদের খান ফের এমপি হওয়ার খায়েসে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। আগের দিন ডা. কাদের খানকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া পিস্তলের ম্যাগজিনের গুলির সূত্র ধরে হত্যা পরিকল্পনাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত তিনজন খুনের ঘটনায় স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে গাইবান্ধা শহরের ব্রিজ রোড এলাকা থেকে তিন খুনি কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুন্দরগঞ্জ উত্তর সমস কবিরাজপাড়া গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২), উত্তর সমস বেকাটারি গ্রামের ওসমান গণির ছেলে শাহীন (২৩) এবং কাদের খানের গাড়িচালক বগুড়ার শাহজাহানপুর থানার কামারপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে হান্নান (২৭)কে গ্রেপ্তার করা হয়। অপর খুনি রানা পলাতক রয়েছে। তাকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। গতকাল গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কার্যালয় চত্বরে প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের কাছে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এসময় রংপুর রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি বশির আহমেদ, গাইবান্ধা পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রেস ব্রিফিংয়ে এমপি লিটন হত্যা মামলার বাদী তার বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী, লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি এবং পরিবারের অন্য সদস্য, গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনসহ জেলা আওয়ামী লীগ, অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ ও জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির নেতৃবৃন্দ
উপস্থিত ছিলেন। এদিকে কাদের খানের বিষয়ে পুলিশের তথ্য প্রকাশের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জানিয়েছেন, কাদের খান জাতীয় পার্টির কেউ নন।
যেভাবে লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়: ডিআইজি জানান, পুলিশ ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে এক মাস ২০ দিনের তদন্ত শেষে ২১শে ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। এমপি লিটনকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় ওই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার মোহেই সাবেক এমপি কাদের খান এক বছর আগে থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি তার ঘনিষ্ঠ ৪ সহচর মেহেদী হাসান, শাহীন, হান্নান ও রানাকে প্রলুব্ধ করেন এবং নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাদের ৬ মাসব্যাপী নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেন। তার ছক অনুযায়ী ইতিপূর্বে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আসার পথে এমপি লিটনকে গত অক্টোবর মাসে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা ব্যর্থ হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তায় প্রথমে তার গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এতে গাড়ি থামিয়ে লিটন বের হয়ে আসা মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে ওই কিলাররা। কিন্তু সে মিশন ব্যর্থ হয়।
সর্বশেষ ৩১শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। লিটন হত্যা মিশনে অংশ নেয় মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নান। এরমধ্যে ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে হত্যা নিশ্চিত করে মেহেদী হাসান। প্রথমে ৩ খুনি লিটনের সঙ্গে জরুরি কথা আছে বলেই বৈঠকখানায় প্রবেশ করে। সেখানে ঢুকেই তাকে সালাম দিয়ে ১ রাউন্ড গুলি ছোড়ে মেহেদী, যা লিটন হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। ওই গুলিটি হাতে লাগে। যেহেতু এই খুনিরা পেশাদার কিলার ছিল না, সেজন্য প্রথম গুলিটি ব্যর্থ হলে মেহেদী ঘাবড়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে এলোপাথাড়ি পরবর্তী ৪ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে। হত্যাকাণ্ড শেষে তাদের ব্যবহৃত ডাইং ব্রাউন্সার রানার ১০০ সিসির কালো রঙের মোটরসাইকেলটিতে চড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। মোটরসাইকেলটি কাদের খানের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত এবং রেজিস্ট্রেশন বাবদ প্রদত্ত ফি জমা করা হয়েছে এমডি আলী নামে। যা পুলিশ জব্দ করেছে। এরপর রাস্তায় অপেক্ষমাণ কাদের খানের গাড়িতে কিলাররা বগুড়ায় তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পরে খুনিরা বাসে ঢাকায় গিয়ে কাদের খানের সহযোগিতায় আত্মগোপন করে থাকে।
যেভাবে কিলাররা সনাক্ত হয়: ব্রিফিংয়ে ডিআইজি জানান, এমপি লিটনের কিলাররা গত ২রা জানুয়ারি গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ধোপাডাঙ্গায় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে ফাইম নামে এক যুবকের কাছ থেকে তার মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনতাই করে। ছিনতাই শেষে তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে পিস্তলের ৬ রাউন্ড বুলেটের ম্যাগজিনটি তাদের অগোচরে রাস্তায় পড়ে যায়; যা স্থানীয় জনগণের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ উদ্ধার করে। এই পিস্তলের বুলেট পরীক্ষা করে দেখা যায়, এমপি লিটনের শরীর থেকে অপারেশন করে বের করা এবং তার বাড়িতে হত্যার পর প্রাপ্ত বুলেটের খোসার সঙ্গে ওই ম্যাগাজিনের বুলেটের মিল রয়েছে। পরে এই সূত্র ধরে খুনিদের আটক করা হয় এবং পিস্তলটির ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।
খুনিদের স্বীকারোক্তি: গ্রেপ্তারকৃত ৩ খুনি মঙ্গলবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করে এবং এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থ যোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও আব্দুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে। এদিকে খুনিরা কাদের খানের পিস্তলটি ব্যবহার করেছিল বলেই বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এদিকে সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান খুনিদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক কাদের খানের পিস্তল এবং বুলেট জব্দ করে। কিন্তু ৪০ রাউন্ড বুলেট ক্রয় করলেও কাদের খান পুলিশকে মাত্র ১০ রাউন্ড বুলেট জমা দিতে সক্ষম হয়েছেন। বাকি ৩০ রাউন্ড বুলেটের হিসাব দিতে পারেননি।
মামলার বাদি ও লিটনের স্ত্রীর সন্তোষ: লিটনের হত্যার পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের গ্রেপ্তার করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী। তিনি এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এই খুনের রহস্য উদঘাটনে নিয়োজিত পুলিশ ও বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান এবং খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতিও এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে: জেলা জজ আদালতে সরকার পক্ষের পিপি অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, চাঞ্চল্যকর এমপি লিটন খুনের মামলাটির জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সে কারণেই এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
১০ দিনের রিমান্ডে কাদের: গতকাল দুপুরে পুলিশ কাদের খানকে গাইবান্ধার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। শুনানী শেষে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক মইনুল হাসান ইউসুফ।