মানুষের বিশ্বাস ফেরানো ও আস্থা অর্জন করা নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এখন মানুষের প্রশ্ন, তারা ভোট দিতে পারবেন কি না। তবে শুধু ইসির সদিচ্ছা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, এ জন্য নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে, তাদের মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন বক্তারা। আলোচনা সভায় নতুন কমিশনের সামনে ১৯টি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে সুজন।
সদ্যগঠিত ইসিকে জনগণের আস্থা অর্জনের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দিয়ে পূর্বসূরি সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনকে জনগণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষ যেন বুঝতে পারে যে, তারা কোনো দলবাজি করছে না। সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কোনো ধরনের সন্দেহ যেন জনমনে সৃষ্টি না হয়।
সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপর নির্ভর করে নির্বাচন করতে হওয়ায় সেই স্বাধীনতার প্রয়োগ সম্ভবপর হয় বলে মনে করেন এ টি এম শামসুল হুদা। এজন্য বিসিএসে নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি ক্যাডার রাখার সুপারিশ করে তিনি বলেছেন, নিধিরাম সরদার হতে গেলে ঢাল-তলোয়ার লাগবে, নিজস্ব কর্মীবাহিনী লাগবে।
সাবেক সিইসি শামসুল হুদা বলেন, সেখানে (ইসি) ডেপুটেশনে লোক আনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, এমনকি জেলা নির্বাচন অফিসারও ডেপুটেশনে আনা যাবে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ক্যাডার বানাতে হবে। আরেক জায়গা থেকে লোক ধার করে কেন করবেন? সেই লোকের উপর তো আপনার নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্বাচনে বাইরের লোকদের আমরা বিকল্প হিসেবে রিটার্নিং অফিসারও বানিয়েছি, আইন করে যা করা হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে।
ইসির ৪ হাজার জনবল থাকলেও তাদের অবকাঠামোগত অভাবের কথা তুলে ধরেন সাবেক সিইসি শামসুল হুদা। তিনি বলেন, আমরা দেখি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে ডিসি সাহেবের পিএসের মতো মনে হয়। তা নেই নিজস্ব অফিস, তার নেই কোনো নিজস্ব লোকবল।
ইসির নিজস্ব কর্মীবাহিনী তৈরিতে বিসিএস ক্যাডার সৃষ্টির সুপারিশ জানিয়ে সাবেক এই সচিব বলেন, নির্বাচন করতে ৭ লাখ লোকের দরকার হয়, তবে সেই ৭ লাখ নিজস্ব লোকের দরকার নেই। নির্বাচন কমিশনের ৪ হাজার লোককে স্বাধীন করতে হবে। ৪ হাজার লোককে নিয়ে ক্যাডার সৃষ্টি করতে হবে।
ইসির নিজস্ব ভবন হওয়ায় খুশি শামসুল হুদা বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের কাছ থেকে ভিক্ষা চাওয়ার মতো করুণা করে একটা অফিস দেওয়া হয়েছিল, অনেক কষ্ট হয়েছে। এত বছর পর নিজস্ব ভবন হয়েছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নাম পরিবর্তন করে ‘নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ’ করা ‘অহেতুক কাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক সিইসি শামসুল হুদা বলেন, আমরা চলে আসার পরে হঠাৎ দেখলাম নির্বাচন কমিশনের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, এটার নাম ছিল ‘বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন’। দেশে যত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান আছে, সব প্রতিষ্ঠানের নামের আগেই ‘বাংলাদেশ’ কথাটা থাকে। ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’, কিন্তু ‘সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশ’ এভাবে নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইত্যাদি।
ইসিতে নিবন্ধনের সময় ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’র ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নাম নেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শামসুল হুদা বলেন, একটা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বন্ধ করে তাদের নাম ঠিক করালাম, সেই নির্বাচন কমিশন তাদের নাম ‘বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন’ পরিবর্তন করে ‘নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ রাখল! এতে মনে হয়, এই নির্বাচন কমিশন বাইরের কারও অ্যাফিলিয়েটেড বটে। কার মাথা থেকে আসলো, খুশিমতো চালু করে দিয়েছে। এটা পরীক্ষা করে, যদি সঠিক না হয়ে থাকে, এটাকে ঠিক করা দরকার। নির্বাচন কমিশনে এটা দেখার দরকার।
ই-ভোটিং সম্পর্কে সাবেক এই সিইসি বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন যদি ই- ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে যে প্রতিষ্ঠানকে জনগণ বিশ্বাস করে সেই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই পদ্ধতি সম্পন্ন করতে হবে।
গবেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা কমিশনের দায়িত্ব। নৈতিক বলপ্রয়োগ ছাড়া শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মানুষের ধারণা পাল্টানো এই কমিশনের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ। এখন রাস্তাঘাটের প্রশ্ন, মানুষের মনের মধ্যে প্রশ্ন, আগামী নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেবে কি না? নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে সেই বিষয়ে মানুষের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।
তিনি বলেন, সংবিধান পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। এটি মাথায় রেখে এখন থেকেই গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করার জন্য কাজ করতে হবে। আইনের প্রচুর সংস্কার করতে হবে। শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়, নির্বাচনকালীন সরকারের মনোভাবও গুরুত্বপূর্ণ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনকে দক্ষ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তবে তাদেরকে সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা দরকার, তাহলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নতুন কমিশনের অংশীজনদের আস্থায় নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সীমিত পর্যায়ে ই ভোটিং চালু করার পরামর্শ দেন।
মূল প্রবন্ধে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নতুন কমিশনের সামনে ১৯টি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কমিশনারের সংখ্যা, কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা অক্ষুন্ন রাখা, প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়োগ, সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, আইনি কাঠামোতে পরিবর্তন আনা, আইনের প্রয়োগ, ভোটার তালিকা তৈরি, সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা, মনোনয়নের ক্ষেত্রে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসার’ সমস্যা দূর করা, সহিংসতা রোধ, আচরণবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নুরুল হুদা কমিশন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সফলতা অর্জন করতে হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। গত কমিশনের ব্যর্থতা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে খাদে ফেলে দিয়েছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জন-অনাস্থা তৈরি হয়েছে। নতুন কমিশন বিতর্কমুক্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, কমিশনের যোগ্যতা ও সদিচ্ছা থাকলেও তা প্রয়োগের পরিবেশ আছে কি না, সেটি দেখতে হবে। নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকলে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
অন্যদের মধ্যে সুজনের নির্বাহী সদস্য সাবেক বিচারপতি আব্দুল মতিন, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মঈনুল ইসলাম, সংসদ সদস্য হুমায়ূন কবির হিরু, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বেঠকে আলোচনা করেন।