তিন মাসের ঘুমন্ত শিশু শিনকে বাসা থেকে চুরির পর ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে গত বৃহস্পতিবার র্যাবের হাতে ধরা পড়লো ইলেকট্রিশিয়ান মো. সুমন। আর গতকাল ভোরে গাজীপুরের টেকনগপাড়া থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ রাব্বি হাসান নিলয় (২২), রাকিব (২০), শাকিল মোল্লা (২১), সোহেল রানা (২০) ও সোহাগ (২৩) এ ৫ অপহরণকারীকে আটক করেছে র্যাব সদস্যরা। সেখান থেকে মিরাজুল ইসলাম (২৫) ও রাকিবুল ইসলাম (১৯) নামে আরও দুই অপহৃত ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল পৃথক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় র্যাব কর্মকর্তারা।
গত বুধবার কেরানীগঞ্জের নামাবাড়ী রিভারভিউ সোসাইটির সাততলার একটি ফ্ল্যাট থেকে শাখাওয়াত হোসেন ও রিতু ইসলাম দম্পতির শিশুটিকে চুরি করে সুমন। বিষয়টি র্যাব-১০ কে জানানোর পর সুমনের মুক্তিপণ দাবির বিষয়টি কাজে লাগিয়ে মুক্তিপণ প্রদানের ফাঁদ পাতে এলিট ফোর্সের সদস্যরা। এরপর কেরানীগঞ্জের গোলাম বাজার এলাকার একটি বাড়ি থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে তাকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় শিশু শিনকে।
গতকাল কাওরানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর। তখন বাবা-মা’র কোলে তোলে দেয়া হয় শিনকে। অপহরণের তিন দিন পর শিশু সন্তানকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শাখাওয়াত ও রিতু।
র্যাব ও ওই দম্পতি জানায়, বাসার ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ বৈদ্যুতিক মেরামতে ইলেক্ট্রিশিয়ান সুমন মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যাওয়া-আসা করতো। গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে সুমন বাসায় যায়। দরজা নক করে। রিতু দরজা খোলে দেয়। কেমন আছে ও কোনো সমস্যা আছে কিনা জানতে চায় সুমন। জবাবে কোনো সমস্যা নেই বলে বলে জানান রিতু। তখন রিতু তাকে বসতে বললে সে বাসায় ঢুকে বসে। এক কক্ষে ঘুমিয়ে আছে শিশু সন্তান। এ সময় রিতু সন্তানের পোশাকের জন্য অন্য কক্ষে যান। রিতু সে কক্ষে ঢুকতেই সুমন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর রিতু চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর পাশের বাসার এক ভাড়াটিয়া দরজা খুলে দিলে এসে দেখে সুমন ও তার সন্তান নেই। বাইরে খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাওয়া যায়নি। বন্ধ পাওয়া গেছে সুমনের মোবাইল ফোন।
এর প্রায় এক ঘণ্টা পর সুমন নিজেই রিতুকে ফোন দেয়। বলে, আমি তোর মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি। মেয়েকে ফেরত পেতে চাইলে দুই লাখ টাকা রেডি রাখ। যখন বলবো নিয়ে আসবি। র্যাব-পুলিশ কাউকে জানালে তোর মেয়েকে পাবি না। এরপরই সে মোবাইল সংযোগ কেটে দেয়। আবার রাত ১১টার দিকে ফোন করে তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করতে বলে। এরপর বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে আবার ফোন করে শিন সুস্থ আছে বলে জানিয়ে কখন কোথায় টাকা নিয়ে যেতে হবে তা জানায়। একই সঙ্গে পুলিশকে জানালে মেয়েকে হারাতে হবে বলেও হুমকি দেয় সুমন। কোন উপায়ন্তর না দেখে শাখাওয়াত হোসেন র্যাব-১০ এর কাছে ঘটনাটি জানালে ফাঁদ পেতে গোলাম বাজারের লাকড়ি ঘরের কাছ থেকে সুমনকে আটক করে। এরপর তার স্বীকারোক্তি মতে ওই এলাকার হাবিব মিয়ার বাসার দোতলার ভাড়াটিয়া আবদুল হক নলীর ফ্ল্যাট থেকে শিনকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির মা না থাকায় দত্তক নেয়ার কথা বলে আবদুল হকের ছেলে পারভেজের কাছে রাখতে দিয়ে যায় সুমন।
র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সন্তানকে কোলে পাওয়ার পর রিতু বলেন, সুমন নামের এক টেকনিশিয়ান আমাদের বাসার ইলেকট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হলে মেরামত করে দিতো। ১৭ই মে সন্ধ্যা সাতটার দিকে দরজায় নক করে তিনি জানতে চান, ভাবি কেমন আছেন? কোনো সমস্যা আছে কিনা? তাকে বাসায় ঢুকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিই। আমার মেয়ে একটি কক্ষে ঘুমাচ্ছিল। আমি আরেকটি কক্ষে তার কাপড় আনতে যাই। এমন সময় হঠাৎ করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে সুমন আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে সুমন স্বীকার করেছে উল্লেখ করে র্যাব আরো জানায়, অপহরণকারী সুমন শিশুটিকে অপহরণ ও ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির কথা স্বীকার করেছে। সে আরো জানায়, অপহরণের কাজটি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে করেছে। অপহরণের পর তার পূর্ব পরিচিত পারভেজের বাসায় শিশুটিকে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে জানায় শিশুটির মা নেই। তাকে সে দত্তক নিয়েছে। শুক্রবার (গতকাল) তার বোন মাদারীপুর থেকে এসে তাকে সেখানে নিয়ে যাবে। তার আগেই র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে শ্রীঘরে পাঠালো।
এদিকে গতকাল ভোরে গাজীপুরের টেকনগপাড়ায় অভিযান চালিয়ে মো. মিরাজুল ইসলাম (২৫) ও রাকিবুল ইসলাম (১৯) নামে দু’অপহৃতকে উদ্ধার করেছে র্যাব সদস্যরা। আগের দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে অস্ত্রের মুখে তাদেরকে অপহরণ করা হয়েছিল। পরদিন টেশনগপাড়ার জনৈক হারুনুর রশিদের নির্মাণাধীন বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বন্দি রেখে স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অপর ভিকটিম মিরাজ গতকাল ভোরে সেখান থেকে পালানোর পর র্যাবের কাছে খবর দিলে অভিযান চালিয়ে বাকিদের উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (এএসপি) মিজানুর রহমান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণের পর চাঁদা দাবির কথা স্বীকার করেছে। অপহরণকারীদের কাছ থেকে ২ রাউন্ড গুলিসহ ১টি বিদেশি পিস্তল, ৩টি ছুরি, ভিকটিমদের ২টিসহ ৬টি মোবাইল সেট ও এক ভিকটিমের একটি ক্রেডিট কার্ড জব্দ করা হয়েছে।