ইউরোপে অবৈধ অভিবাসীরা কোন দেশ থেকে বেশি আসছে? আপনি হয়তো মনে করতে পারেন সিরিয়া কিংবা অন্য কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে। তেমনটা ভাবলে আপনি ভুল করবেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা, আইওএম অনুযায়ী, ইউরোপে অভিবাসী সবথেকে বেশি যাচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক দেশ থেকে। দেশটি হলো বাংলাদেশ। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি অভিবাসীরা শুধু লিবিয়া পৌঁছাতে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার ডলার খরচ করছে। সেখান থেকে অনিশ্চিত যাত্রাপথে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি পৌঁছাতে ব্যয় করছে অতিরিক্ত আরও ৭০০ ডলার।
অভিবাসীদের বেশির ভাগ কাজের সন্ধানে ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভিনদেশে। আর অভিবাসীদের কাজ বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী মারা গেছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান মোতাবেক সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানে আনুমানিক ৩৭ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে। এদের মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৮ সহস্রাধিক অভিবাসীর মরদেহ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। নিয়োগদাতারা প্রায়ই শ্রমিকদের অমানবিক কর্মপরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করে। কর্মীদের পাসপোর্ট জব্দ করে তাদের জিম্মি করে রাখে। এসব অভিবাসী কর্মী বিদেশ বিভুঁইয়ে আটকে পড়ে আছে। তারা দেশে ফিরতে পারছে না।
বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও কেন এতে বেশি বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমায়?
অনেক বাংলাদেশির কাছে জীবনধারার মান উন্নত করার অন্যতম পাথেয় হলো বিদেশে পাড়ি জমানে। দেশটি ১৯৯১ সাল থেকে ২০১০ সালে দারিদ্যের হার ৪৪.২ শতাংশ থেকে ১৮.৫ শতাংশে কমিয়ে আনলেও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। এ ছাড়া দেশটি কাঠামোগত বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি: ১৬ কোটি ৪৮ লাখ জনসংখ্যার আনুমানিক ৩৪ শতাংশ শহুরে এলাকায় বসবাস করে। বন্যার পানি, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রউচ্চতা এবং অগ্রসরমান লোনা পানি মানুষকে উপকূলবর্তী এলকা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। তারা জনবহুল শহরগুলোতে ধাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের হার রয়েছে। চাকরির বাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম হওয়ায় অনেক তরুণ পুরুষ ও নারী বিদেশে চাকরির খোঁজ করে। বাংলাদেশি জনসংখ্যার ৫.৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক অভিবাসী কর্মী। তাদের শীর্ষ ৫ গন্তব্যের চারটিই মধ্যপ্রাচ্যে- ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। সেখানকার বৈরী কর্মপরিবেশ তাদের ইউরোপের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে ইতালিতে। রোমে বাংলাদেশিরা মিনিমার্চ চালায়, রাস্তার দোকানি হিসেবে কাজ করে। সেখানে তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। নিজেদের সম্প্রদায়ের নানা প্রতিষ্ঠানও চালায় তারা। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এসব অভিবাসী শত শত কোটি ডলার দেশে পাঠায়। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটা বিরাট ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের অভিবাসনের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে তেলক্ষেত্রে কর্মীদের চাহিদা মধ্যপ্রাচ্যে গণঅভিবাসন ত্বরান্বিত করে। সৌদি আরব ও দুবাইতে কাজ করা তরুণদের স্বপ্নে পরিণত হয়। এসব কাজের সুযোগ (অনেকক্ষেত্রে এসব চুক্তি ছিল অস্থায়ী) উন্নততর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে উন্নীত হওয়ার রাস্তা তৈরি করে দেয়। কেননা, অভিবাসীদের পরিবারগুলোকে অপেক্ষাকৃত ধনী দেখাতো। আর অভিবাসী কর্মীদের দেখা হতো সফলতার নির্দেশক হিসেবে।
বিশেষ করে দরিদ্র ও অদক্ষ কর্মীদের অভিবাসী রিক্রুটমেন্ট- অবৈধ ও সহিংস চর্চার বিরাট এক খাতে পরিণত হয়। অভিবাসী প্রেরণ ও গ্রহণকারী দেশগুলোতে এবং দেশগুলোর মধ্যে রিক্রুটাররা বিরাট এক নেটওয়ার্ক স্থাপন করে। তারা তাদের সেবার জন্য চড়া ফি আদায় করে। মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে ফিলিপাইন বা শ্রীলঙ্কার তুলনায় খরচ হয় ৪.৫ গুণ বেশি। আর বাংলাদেশে এই অর্থের ৬০ শতাংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। ১৮ শতাংশ যায় সহকারীদের কাছে। অতিরিক্ত ১০ শতাংশ যায় রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোতে।
মধ্যপ্রাচ্য ক্রমশ কম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে:
সৌদি আরব আগের মতো ব্যাপক সংখ্যায় বাংলাদেশি শ্রমিক নেয় না। দেশটি ২০১৬ সালে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর ৬ বছরের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেও, এতে রিক্রুটমেন্ট বাড়ার সম্ভাবনা কম। কেননা, তেলের দাম কমে যায় সেখানে হাজার হাজার কর্মী বেকার অবস্থায় কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এমন কর্মীদের বেশির ভাগই ভারতীয়। অন্যরা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় দেশগুলো থেকে ফিরে আসছে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে ৩৬ হাজারের বেশি শ্রমিক দেশটি থেকে ফিরে এসেছে। বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও অধিকার লঙ্ঘনের ওপর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আর গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়া অনেক দেশের শরণার্থী ও অভিবাসীদের জন্য ইউরোপের প্রবেশদরজায় পরিণত হয়েছে। এসব অভিবাসীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার বিপজ্জনক যাত্রায় নামতে ইচ্ছুক। এদের মধ্যে এ বছর ইতালিতে পৌঁছেছে ২৮০০ বাংলাদেশি।
ইউরোপে অবৈধ অভিবাসন বাংলাদেশিদের জন্য নতুন নয়। ২০১৫ সালে লিবিয়া সরকার তাদের দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। দেশটি দাবি করেছিল, অনেকে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছিল। অন্যরা যারা ইউরোপে অবৈধভাবে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু লিবিয়ার দুর্বল রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকের জন্য ভূমধ্যসাগর দিয়ে পাচারের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে দেয়। এখন ক্রমশ বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি এই পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশি শ্রম বাজার অব্যাহতভাবে কঠিন: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তরুণদের বিদেশে পাড়ি জমাতে উদ্বুদ্ধ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বেশি বেকারত্বের হার বাংলাদেশে। স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বেকারত্বের হার বেশি। মুদ্রাস্ফিতি ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছে যে ২০১৩ সালে আনুমানিক ৪১ শতাংশ বাংলাদেশি তরুণ হয় বেকার ছিল বা শিক্ষা অথবা প্রশিক্ষণরত। আর তরুণদের মধ্যে বেকার ছিল ৭৮ শতাংশ।
দক্ষ কর্মীরা শুধুমাত্র পৃষ্ঠপোষক থাকলে সরকারি চাকরি পায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকক্ষেত্রে শুধু শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করে। আর উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণেও অনেক সময় দুর্নীতি দেখা যায়- স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ঘুষ বা রাজনৈতিক যোগসূত্র ছাড়া ঢুকতে পারে না।
অদক্ষ শ্রমিকরা কৃষি, যোগাযোগ বা শহরগুলোতে নির্মাণ খাতে অস্থায়ী চুক্তিতে কাজ করে থাকে। এদের বেশির ভাগ আসে গ্রাম থেকে। বেসরকারি সংগঠনগুলো গ্রাম্য অঞ্চলগুলোতে নানা উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে প্রবেশ করেছে। তারা নারী উন্নয়নকে টার্গেট করেছে, পুরুষদের পেছনে ফেলে রেখেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, আইনহীনতা এবং বিরোধীদের ওপর অভিযান জীবনযাত্রাকে আরো বেশি অনিশ্চিত করে দিয়েছে।
এছাড়া, একসময় বাংলাদেশের প্রাণবন্ত তৈরি পোশাক খাত থেকে অনেক রিটেইলার সরে গেছে বিপজ্জনক কর্মপরিবেশ ও রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে। এই খাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে অবদান রেখেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা কারখানা ধসে ১১৩৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর বৈশ্বিক রিটেইলাররা যেসব সংস্কার দাবি করেছিল তার পুরোটা এখনও মানতে পারে নি বাংলাদেশের কারখানাগুলো। সাম্প্রতিক, বড় একটি গার্মেন্ট শিল্প সম্মেলন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে ৫টি বড় ক্লোদিং ব্র্যান্ড। মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে কেন্দ্র করে কয়েক শ’ কর্মীকে বরখাস্ত করার ঘটনায় তারা সম্মেলন থেকে সরে যায়। গার্মেন্ট খাতের এসব সমস্যার কারণে হাজারো শ্রমিক অন্য চাকরি খুঁজছে।
এ কারণে হাজারো চেষ্টা করছে ইউরোপ পাড়ি দিতে: লিবিয়া থেকে ইতালি পথে ১ হাজারের বেশি অভিবাসী মারা গেছে এ বছর। তারা শুধু সংঘাত ও নিপীড়ন এড়ানোর চেষ্টা করছে তাই নয়, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দৈনদশা কাটাতে নিজেদের জীবন ও সহায়সম্বল ঝুঁকিতে ফেলছে। ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের স্বাগত জানায় কি না তা দেখার বিষয়।