গাজীপুরের মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে নিহত তেরো পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোককে হারিয়ে তারা এখন দিশাহারা। যদিও নিহত প্রত্যেক পরিবারকে বীমা ও মন্ত্রণালয় এবং কারখানার পক্ষ থেকে আট লাখ টাকা করে অনুদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার জন্য কেউ কেউ কারখানা কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিকে দায়ী করছেন। তবে এর তদন্ত শুরু করেছেন জেলা প্রশাসকের গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর তদন্ত করে কারো অবহেলা বা খামখেয়ালি পাওয়া গেলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর পুলিশের কর্মকর্তাগণ।
মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড পোশাক কারখানায় ২৪ বছর ধরে চাকরিরত কর্মরত বাবা আব্দুস সালামের দীর্ঘ ছুটি নেই। তাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ব্রাহ্মণসুন্দর গ্রামের মেহেদী হাসান মা আর অপর দুই ভাইকে ছেড়ে গাজীপুরে এসেছিল বাবা সালামের সঙ্গে ঈদ করতে। বাবা আর ছেলের ঈদ ঠিকই হয়েছে, কিছুটা আনন্দও হয়েছে। কিন্তু ঈদের এই আনন্দ বেশি দিন টিকেনি। মেহেদী এবার দিয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। বাবার ইচ্ছে ছিল বিবিএ-এমবিএ পাস করিয়ে ছেলে বড় চাকরি করবে। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙ্গে মাটি হয়ে গেছে সেই তরুণ মেহেদী আর তার বাবা কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে নিহত আব্দুস সালামের। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ছেলে মেহেদী ছোট দুই ভাই অষ্টম শ্রেণি আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মেহেদীর দুঃখ, এসেছিলাম বাবার সঙ্গে ঈদ করতে, আর গ্রামে ফিরতে হেচ্েছ বাবার লাশ নিয়ে। মা আর দুই ভাইকে গিয়ে কি বলব। কলেজ পড়ুয়া মেহেদী আরো বলতে থাকে ২৪ বছর ধরে যে কারখানায় বাবা শরীরের ঘাম ঝরিয়ে কাজ করেছে, সেই কারখানাই বাবার রক্ত নিয়েছে। প্রাণ নিয়েছে। এটা কোনো ভাবেই মানতে পারছে না মেহেদী। তাই সামনে লাশ রেখে বার বার নির্বাক হয়ে যাচ্ছিল এই তরুণ। চাচা আর আত্মীয়রা কোনো সান্ত্বনা দিয়েই তার কান্না-আহাজরি থামাতে পারছিল না। তরুণ ছেলের এই কান্নায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকের চোখেই পানি ছলছল করছিল। একজন প্রতিবন্ধী সন্তানসহ তিন সন্তানকে নিয়ে কষ্টে পড়ে গেছেন বয়লার বিস্ফোরণে নিহত চট্টগ্রামের মনসুরের স্ত্রী তাছলিমা আক্তার। তার শুধুই আহাজারি আর প্রশ্ন তার জীবনটা কেন এমন হলো। ফেনীর এরশাদ উল্লাহ ওই করাখানার ইলেক্ট্রিশিয়ান পদে চাকরি করতেন। দুর্ঘটনার দিন তিনি কারখানায় আসেন। তার ভাই আব্দুল্লাহ জানান, ১২ বছর ধরে এ কারখানায় চাকরি করেন এরশাদ। চার মাস আগে তিনি বিয়ে করেছেন। ঈদের ছুটি শেষে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুরে কর্মস্থলে আসেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে এরশাদ সবার বড়। তার নববধূর আহাজারিতে আর শোকের মাতমে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তাদের মতো দুঃখ আর কষ্টের গল্প ওই কারখানায় কাজ করা আরো দশ পরিবারের। যাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। যারা নিশ্বাস আর চোখের জল ফেলতে ফেলতে একে একে ময়নাতদন্তের পর কিংবা ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের মরদেহ নিয়ে গেছেন হাসপাতাল মর্গ থেকে।
নিহতদের স্বজনরা কেউ কেউ মর্মান্তিক এই বয়লার বিস্ফোরণের জন্য করাখানা কর্তৃপক্ষকে দুষছেন। বলছেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া বয়লারটি বিস্ফোণের বিষয়ে হয়তো তদন্তে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তাদের প্রাণ তো আর ফিরে আসবে না। কারখানা কর্তৃপক্ষের আবহেলা আর খামখেয়ালির কারণেই আজ বয়লার বিস্ফোরণে এতগুলো মানুষের জীবন দিতে হয়েছে। এই দায় মালিকপক্ষ কোনো ভাবেই এড়াতে পারবেন না। তবে এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন। আর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলছেন, এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে কেউ মামলা না করলেও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে এবং মামলার পর তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলা: মাল্টিফ্যাবস লি: কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। রাতে সহকারী উপপরিদর্শক আব্দুর রশিদ বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরো ৮ জনকে আসামি করে জয়দেবপুর থানায় মামলা করেন। বয়লার বিস্ফোরণের পর কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিন গুনছেন এখানকার হাজারো শ্রমিক।