ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের বেহাল দশা। ৪টি এসি’র সবক’টি নষ্ট। ৫টি ফ্রিজের মধ্যে তিনটি নষ্ট। সচল দু’টির মধ্যে একটিতে গত কয়েক দিন ধরে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় চারটি লাশের ধারণক্ষমতা সমপূর্ণ একটি ফ্রিজ দিয়েই চলছে ৪০টি লাশ সংরক্ষণের কাজ। ঢামেকের মর্গ এলাকায় গেলেই এখন ভেসে আসে উৎকট গন্ধ। এখানেই প্রিয়জনের লাশের অপেক্ষায় বসে থাকেন স্বজনরা। সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় নষ্ট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ আলামত। অনেক সময় লাশ এতটাই বিকৃত হচ্ছে যে, শনাক্ত করার কোনো উপায় থাকছে না। লাশ কাটাও হয় সনাতন পদ্ধতিতে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মর্গের মেঝেতে ট্রেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে ৮-১০টি লাশ। এসব লাশ থেকে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। ঢামেকের মর্গ ইনচার্জ মো. সেকান্দার জানান, গরমে লাশগুলো পচেগলে যাচ্ছে। ফ্রিজে জায়গা নেই। ৫টি ফ্রিজের মধ্যে ৩টি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। আর দুটি জঙ্গি, বিদেশি ও অজ্ঞাত লাশের দখলে। মর্গের চারটি এসির সব কটিই নষ্ট। পর্যাপ্ত ফ্যানও নেই। ঢামেক মর্গে প্রতি বছর রাজধানীর অধিকাংশ থানা ছাড়াও অন্যান্য এলাকা থেকে আসা তিন হাজারেরও বেশি লাশের ময়নাতদন্ত হয়, যা অন্যান্য মেডিকেল কলেজের তুলনায় ছয় গুণেরও বেশি। সেকান্দার জানান, ফ্রিজের অভাবে লাশ পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। গাদাগাদি করে একটা লাশের ওপর আরেকটা রাখা হয়েছে। পচা লাশ ভালো লাশের ওপর রাখলে ভালো লাশও নষ্ট হয়ে যায়। লাশের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার কারণে মর্গের পাশ দিয়ে কেউ চলাচল করেন না। সেভলন, আগরবাতি, ধুপ জালিয়ে রাখা হয় গন্ধের জন্য। তিনি জানান, মর্গের পাশেই এনাটমি বিভাগ। সেখানে আগত ছাত্রছাত্রী শিক্ষক দুর্গন্ধে ক্লাস করতে পারছেন না। ইতিমধ্যে এনাটমি বিভাগের পক্ষ থেকে ফরেনসিক বিভাগকে চিঠিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মর্গের আরেক সহকারী বাবুল চন্দ্র দাস জানান, অজ্ঞাত লাশ নিয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কবর দেয়। কিন্তু তারা গত ১২ দিন ধরে কোনো লাশ নিচ্ছে না। যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেয় না। এজন্য লাশের সংখ্যা আরো বাড়ছে। ফরেনসকি বিভাগ ও মর্গ সূত্রে জানা গেছে মর্গে এখন চারজন জঙ্গি, ২ জন ভারতীয়, ১ জন নাইজেরিয়ান, ১ জন সাউথ আফ্রিকান, ঢামেক হাসপাতালের ২ রোগী, ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে আসা ১৬টি অজ্ঞাত ও ১২টি নবজাতকের লাশ রয়েছে। ভাল থাকা দুটি ফ্রিজে সাধারণত ৮টি লাশ রাখার কথা। কিন্তু ৮টি লাশের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিজে তিন ঘণ্টা পরপর পালাবদল করে লাশ রাখা হচ্ছে। বর্তমানে মর্গে প্রায় ৪০টি লাশ রয়েছে।
মেডিকেলের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উন্নত বিশ্বে ময়নাতদন্তের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল করাত, উন্নতমানের এক্স-রে মেশিন ও এক্সলাবিন (আলামত রক্ষাকারী বাক্স)। ইলেকট্রিক্যাল করাতের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশ দ্রুত ও সূচারুরূপে কাটা যায়। এতে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয় কম। এক্স-রে মেশিনের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির শরীরের কোনো স্থানে বুলেট আছে কি না তা দ্রুত নির্ণয় করা যায়। পরে যথাযথ স্থানে কেটে মামলার আলামত বুলেটটি উদ্ধার করা যায়। ‘এক্সলাবিন’ বাক্স দিয়ে বিদেশি কোনো নাগরিকের আলামত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়। এর অভাবে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানোর আগেই আলামতগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভিকটিমের বিষয়ে ওই দেশের ফরেনসিক বিভাগ যথাযথ তথ্য পায় না। এ তিনটি যন্ত্রের একটিও নেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত ছাড়াও মর্গে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে ফরেনসিক বিষয়ে ক্লাস নেয়া হয়। প্রতিটি ব্যাচে অর্ধশত শিক্ষার্থী ছোট্ট একটি রুমে কাজ করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ সমস্যার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মর্গটি কলেজের তাই অধ্যক্ষকে বিষয়টি অবগত করব। কারণ, এই সমস্যার সমাধান না হলে কাজ করা যাবে না। এসি ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেছে। লাশ পচে দুর্গন্ধ। আশপাশের ভবন থেকে অভিযোগ আসছে। তবে মর্গে এখন সবচেয়ে জরুরি একটি এক্স-রে মেশিন। কারণ নিহত কোনো ব্যক্তির শরীরে যদি বুলেট থাকে। তবে আমরা সেটি সহজেই সনাক্ত করতে পারি না। অনেক সময় বুলেট শরীরের এমন কিছু জায়গায় চলে যায় খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এজন্য লাশকে অনেক সময় কুচি কুচি করতে হয়। এছাড়া কিছু আঘাতের চিহ্ন খালি চোখে সনাক্ত করা যায় না। এক্স-রে মেশিনের সাহায্য সনাক্ত করে সহজেই কাজ করা যায়। লাশের ডেথ অব কজ (মৃত্যুর কারণ) খুব তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়।