প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিধায় উল্লেখ করে বিদ্বেষমূলক সাম্প্রদায়িক উস্কানির পাশাপাশি তাঁর চরিত্রে কলঙ্কের কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চলছে। প্রধান বিচারপতি ইস্যুতে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের আড়াই কোটি ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা প্রকাশ করতে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন এডভোকেট রানা দাসগুপ্ত। তিনি বলেন, আমরা আরও উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, প্রধান বিচারপতি ইস্যুকে সামনে রেখে সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহলবিশেষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে তৎপর। পত্রপত্রিকার সংবাদে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে প্রধান বিচারপতির রায়কে (ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়) পুঁজি করে সরকারের অভ্যন্তরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহলবিশেষ তাঁর (প্রধান বিচারপতি) ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পদোন্নতি, উন্নততর পদায়ন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করার সর্বনাশা প্রক্রিয়া আগের মতোই আবার শুরু করেছে। এর ফলে মেধা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতায় এগিয়ে থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দারুণ হতাশা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতিতে আগের মতোই আবারও বঞ্চনা-বৈষম্যের ধারাটি এগিয়ে আসছে কিনা তা ভেবে সংখ্যালঘু জনগণ শঙ্কিত। রানা দাসগুপ্ত অভিযোগ করে বলেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের জনৈক সিনিয়র সচিবের অপতৎপরতার অভিযোগও ইতিমধ্যে উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের এ সময়কালের সুদীর্ঘ সাত দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কেবলমাত্র একজনই তার মেধা, মনন ও যোগ্যতায় সাংবিধানিক পদ অলঙ্কৃত করেছেন। আর তিনি হলেন- প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রানা দাসগুপ্ত বলেন, সরকারি দল ও সরকারের একাংশের তীব্র বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে (সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগে সম্মতি দেন। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শুধু প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই পরিচয় দেননি, সাম্প্রদায়িক বাতাবরণের খোলস ভেঙে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরিরও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যেদিন প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে শপথবাক্য পাঠ করানো হয় সেদিনই সরকারি দলের কখনো অঙ্গ সংগঠন, কখনো বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে পরিচয়দানকারী ওলামা লীগ জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে কথিত এক প্রতিবাদী মানবন্ধনের আয়োজন করে ‘মুসলমান রাষ্ট্র বাংলাদেশে হিন্দু প্রধান বিচারপতি মানি না’ বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অথচ আমরা জানি মুক্তিযদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক ধারায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী এই সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এজন্য তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।
রানা দাসগুপ্ত বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সাতজন বিচারপতির সর্বসম্মত রায়ের প্রেক্ষিতে আমরা ইতিমধ্যে গভীর দুঃখ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, শুধুমাত্র প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে টার্গেট করে সরকারি দল ও জোটের মহল বিশেষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে একতরফা, বিদ্রূপাত্মক বক্তব্যই উপস্থাপন করা হয়নি, তার জন্ম-পরিচয়, ধর্ম সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি ইত্যাদি পরিচয়ে এমনকি রাজাকারের মিথ্যা অভিধায় উল্লেখ করে বিদ্বেষমূলক সাম্প্রদায়িক উস্কানিও অব্যাহতভাবে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি তাকে দেশ্যত্যাগে বাধ্য করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। রানা দাসগুপ্ত বলেন, আমরা এদেশের আড়াই কোটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সচেতন জনগণের মতোই তা অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে মনে হয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রদায়িক রায়কে (ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়) কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতিকে কটাক্ষ করে সরকার, সরকারি দল ও জোটের দায়িত্বশীল কোনো কোনো মন্ত্রী এবং নেতাদের বক্তব্য থেকে যেসব বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তা আওয়ামী ওলামা লীগের বক্তব্যেরই প্রতিফলন।
তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রধান বিচারপতিই। তাঁর ধর্ম বিশ্বাস থাকতে পারে। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে তার একমাত্র পরিচিতি তিনি প্রধান বিচারপতি- হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা আদিবাসী নন। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতিসহ যে কোনো বিচারপতি বা বিচারকের রায়, আদেশ নিয়ে মামলার যে কোনো পক্ষ বা রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক সংক্ষুদ্ধ হতেই পারেন। কেই সংক্ষুদ্ধ হলে সংবিধান, আইনে তার প্রতিকারের বিধান যেমন আছে তেমনি রায় বা আদেশ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, তর্ক-বিতর্কও চলতে পারে। তবে, বিচারপতি বা বিচারকের ধর্মবিশ্বাস বা তার সম্প্রদায়গত অবস্থানকে কটাক্ষ করা হলে তা অবশ্যই সেই ধর্মের বিশ্বাসী লোকজন বা সম্প্রদায়কে আহত করে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক ধারা থেকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িক অগণতান্ত্রিক অপশক্তিকে উৎসাহিত করবে। সরকারের ও সরকারি দলের ভেতরকার ঘাপটি মেরে থাকা কোনো মহল কোনো প্রকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে প্রধান বিচারপতির ইস্যুকে মূলধন করে সাম্প্রদায়িক চক্রান্তে লিপ্ত কিনা তা খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানানো হয় পরিষদের পক্ষ থেকে। এছাড়া দেশের সকল গণতান্ত্রিক, সামাজিক, নাগরিক, সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছেও বিদ্যমান জটিল পরিস্থিতি নিরসনে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
রানা দাসগুপ্ত বলেন, প্রধান বিচারপতি শুধু আমাদের নন, তিনি রাষ্ট্রের। আর আমরা রাষ্ট্রের বিষয়ে বলতে আসিনি। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে সামনে রেখে যে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং যেভাবে আমাদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- এখানেই আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমরা প্রকাশ করছি। এক প্রশ্নের জবাবে রানা দাসগুপ্ত বলেন, এ পর্যন্ত অসংখ্য প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু এমনভাবে তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে তুলে ধরে সম্প্রদায়কে সামনে রেখে কটাক্ষ করে কখনো আক্রমণ করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিউবার্ট গোমেজের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, যে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে সেটি গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশকে অগ্রসর করার স্বার্থেই এই উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিক্রিয়া নয়। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, সুব্রত চৌধুরী, জয়ন্ত সেন দীপু, জেএম ভৌমিক, মিলন কান্তি দত্ত, যুগ্ম সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী পরিচালক পলাশ কান্তি দে প্রমুখ।