কিশোর মো. হাসান (১৭) পড়তো অষ্টম শ্রেণিতে। রাজধানীর চকবাজারের লালবাগ এলাকার ইসলামবাগ আইডিয়াল স্কুলে। বাবা মোহাম্মদ আলীর কাছে তার বায়না ছিল- জেএসসিতে ভালো করলে বাবা যেন তাকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেন। জেএসসিতে ভালো করা বা এজন্য বাবার কাছ থেকে মোবাইল নেয়া হলো না হাসানের। তার আগেই সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রাণ গেল
তার।
একই এলাকার মোহাম্মদ আলী পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।উভয়ের মধ্যে ছিল সিনিয়র-জুনিয়রিটির দ্বন্দ্ব। এর জেরে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ৯টার দিকে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে দু’জন। দু’জনের পেছনে দু’টি পক্ষ। এতে জুনিয়র মোহাম্মদ আলীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারায় সিনিয়র হাসান। রাজধানীর চকবাজার থানার ৪৮ নম্বর বল কুমার দত্ত রোডে শহীদ আফতাব হাসপাতালের কাছে ঘটে এই ঘটনা।
শুক্রবার রাতেই হাসানকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শনিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে মারা যায় সে। এ ঘটনায় হাসানের পিতা মোহাম্মদ আলী ছুরিকাঘাতকারী আলীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ছিল ঢামেক মর্গে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত হাসানের ঘনিষ্ঠ ও বয়সে বড় নিলয় আহমদ সুমন বলেন, এলাকায় ছেলেদের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে সিনিয়র-জুনিয়রিটির দ্বন্দ্ব রয়েছে। কয়েক মাস আগেও দু’পক্ষের ২০ থেকে ২৫ জন করে ছেলে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এলাকার বড় ভাইদের চেষ্টায় তা সংঘর্ষে জড়ায়নি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গলির ভেতর রাস্তার পাশে বেশকিছু ঠেলাগাড়ি রাখা ছিল। এগুলো প্রায়ই থাকে। মাথার উপর একটি সড়কবাতি আছে। এরকম স্থানে গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে আমি ছিলাম। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হাসান, বাবু ও সোহান কিছুটা এগোয়। সেখানে একটি ঠেলাগাড়িতে বসে ধূমপান করছিলো মোহাম্মদ আলীসহ আরো ৭-৮ ছেলে। যাওয়ার সময় মোহাম্মদ আলী হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলে, হাসান কোথায় যাস। এতে হাসানের সম্মানে লাগে। সে বলে, তোমরা সম্মান করে কথা বলো। আমরা বড় ভাইরা যাচ্ছি। তোমরা আমাদের সম্মান করবে না? এরপরই উভয়ের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। সেখান থেকে হাতাহাতি। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ আলী ছুরি বের করে হাসানের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। তাকে রক্তাক্ত হতে দেখে সবাই সটকে পড়ে। এই ঘটনা দেখে আমি সামনে এগিয়ে যাই। হাসান আমাকে তার গেঞ্জি উপরে ওঠিয়ে তার ক্ষতস্থান দেখায়। রক্ত ঝরছিলো। এরপর আমার গায়ের উপর ঢলে পড়ে। রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে তার পেট বেঁধে ফেলি। একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের উদ্দেশে রওয়ানা দেই। আসার পথে সে বলেছে, ‘আপনারা বড় ভাইরা আছেন। আলী আমাকে ছুরি মেরেছে। এই ঘটনার বিচার করবেন।’ ঘণ্টাখানেক পর হাসপাতালে পৌঁছি। কিন্তু তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। শনিবার ভোরে সে মারা যায়।
হাসান চকবাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাসরত বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি ও দোকানদার মোহাম্মদ আলীর ছেলে। তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার মদনখালী গ্রামে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল দ্বিতীয়। তার বড় বোন মাহমুদা আক্তার ঢাকা ইডেন কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছোট বোন সামিয়া আক্তার পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তার মা নাসিমা আক্তার একজন গৃহিণী। ওই দিন বাইরে থেকে ঘুরে আসার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় হাসান।
হাসানের পিতা মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার ছেলে পড়াশোনা করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল। কিন্তু সিনিয়র-জুনিয়রিটির দ্বন্দ্বে প্রাণ গেল তার। এমন ঠুনকো ঘটনায় আর যেন কোনো বাবা-মা’র বুক খালি না হয়। আলীসহ কয়েকজন তাকে ধরে মারধর ও ছুরিকাঘাত করেছে। আমি এর বিচার চাই। তাদেরকে ধরলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।