হামিম রাফি , নিউজ ডেস্কঃ হিরো-ভিলেনের মিশেল
তাঁদের সম্পর্কটা ৩০ বছরের বেশি সময়ের। একসঙ্গে থিয়েটার করেছেন।
বয়সের পার্থক্য মাত্র দুই বছরের, তৌকীর বড়। একে অপরকে ‘আপনি’ এবং ‘ভাই’ বলে ডাকেন। “আমরা একসঙ্গে অভিনয় শিখেছি ‘নাট্যকেন্দ্র’ দলে। একে অপরকে ভাই বললেও আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো”, বললেন জাহিদ হাসান।
নব্বইয়ের দশকজুড়ে টিভি নাটকে ছিল তাঁদের দুজনের দাপট। ছিলেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তৌকীর আহমেদ এখন ব্যস্ত পরিচালনাতেই। এবারই প্রথম নিজের ছবিতে জাহিদকে নিলেন তৌকীর। জাহিদ বলেন, ‘উনি আমাকে সিনেমার অফার করবেন, আমার তো না বলার কারণ নেই।
উনি আমাকে জানেন, আমার অভিনয় দক্ষতা বা অভিনয়ের ধরন তাঁর মুখস্থ। তেমনি আমিও তাঁকে ভালোভাবেই জানি। ’
সব পরিচালকেরই একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সেটাই তিনি পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। পরিচালক তৌকীরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? ‘তৌকীর ভাইয়ের আগের ছবিটাও [অজ্ঞাতনামা] বেশ প্রশংসিত হয়েছে। পরিচালক হিসেবে এরই মধ্যে তিনি উত্তীর্ণ। আগেও বেশ কিছু প্রশংসিত সিনেমা করেছেন। এই ছবিটাও ভালো হয়েছে। একজন অভিনেতা পরিচালক হওয়াতে আমাদের বোঝাশোনাটা বরং বেশি ভালো হয়েছে। অনেক পরিচালক নিজে কী চান সেটাই বোঝাতে পারেন না। আমি কাউকে ছোট করে বলছি না। কিন্তু তৌকীর ভাই কোনো কোনো দৃশ্য নিজে অভিনয় করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ইউনিটের সবার জন্যই সেটা ছিল বাড়তি পাওনা। ’
নদীর নামে ছবির নাম—‘হালদা’। শুটিং হয়েছে চট্টগ্রামে, হাতিয়া নদীতেই। বেশ কষ্ট করতে হয়েছে নিশ্চয়ই? ‘সহশিল্পীদের সবাই পরিচিত। অনেক দিন ধরে কাজ করছি। এমনকি যিনি ক্যামেরাম্যান তিনিও আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থিয়েটার করতেন। যদি তৌকীর ভাইয়ের কথা বলি, পরিচালক চেয়েছেন আমি যেন সেটে কমফোর্টেবল থাকি, আমিও চেয়েছি পরিচালককে যতটা সম্ভব কমফোর্টেবল রাখতে। পারস্পরিক রেসপেক্ট আর ভালোবাসাই আমাদের সিনেমাটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটা সুন্দর পরিণতি হয়েছে’, বললেন জাহিদ।
ছবিতে নিজের চরিত্র নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। হাসিমুখে বললেন, ‘সেটা হলে গিয়ে দেখতে হবে। ’ তিনি যে ছবিতে ভিলেন, যারা ট্রেলার দেখেছে তাদের কারোই তা অজানা নয়। তবে নিজেকে ‘ভিলেন’ বলতে রাজি নন জাহিদ, ‘বাস্তবে কেউই কিন্তু ভিলেন না। যে লোকটা খারাপ কাজ করে তারও একটা ভিউ আছে। প্রত্যেকটা মানুষই হিরো-ভিলেনের মিশেল। কে কিভাবে নেয় সেটাই আসল। ছবিতে দর্শক যখন আমার কার্যকলাপ দেখবে তখন হয়তো মনে হবে চরিত্রটা তো ঠিকই করছে। ভিলেন বা নায়ক, কী হলাম সেটা বড় বিষয় না। মূল ব্যাপার হলো চরিত্রটাকে কতটা প্রাণবন্ত করতে পেরেছি। ’
সর্বশেষ বড় পর্দায় দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে, ‘প্রজাপতি’তে। এত লম্বা বিরতি কেন? ‘কেউ ডাকেনি…[হাসি]। সত্যি বলতে অনেকেই ডেকেছেন কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি। দশজনে ভালো বললে সেটাকে যে আমিও চোখ বুজে ভালো বলব, এমনটা নয়। নিজের ভালো লাগার একটা বিষয় আছে। এত দিন শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে থেকে আমার একটা নিজস্ব বোধ তৈরি হয়েছে। সেখানে খাপ না খেলে তো করা যায় না। ’
সম্প্রতি কলকাতার ছবি ‘সিতারা’য় অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। আশীষ রায়ের ছবিটি কথাসাহিত্যিক আবুল বাশারের ‘ভোরের প্রসূতি’ উপন্যাস অবলম্বনে। জাহিদ বলেন, ‘দুই মাস ধরে ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। একসময় আমরা কথা বলি। উপন্যাসটা পড়ে ভালো লেগেছে। পরে স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ছবিতে আমার চরিত্রের নাম দিলু। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার ভারত অংশে শুটিং হবে। এ মাসের শেষেই শুটিং হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া বন্যার কারণে সেখানে এখন শুটিং করার পরিবেশ নেই। জানুয়ারিতে শুটিং হবে, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। ’
তৌকীর আহমেদের ছবি তুলেছেন হিমেল
বাংলাদেশের ছবিতে আমি ড্রয়িংরুম দেখতে চাই না
‘অজ্ঞাতনামা’ আপনার জন্য অম্ল-মধুর স্মৃতি। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর মানুষ দেখতে যায়নি। সেই সিনেমাই আবার ইউটিউবে দেখার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড়!
যে ধরনের প্রচারণার মধ্য দিয়ে ছবিটি মুক্তি পাওয়া উচিত ছিল সেটা হয়নি। হয় প্রযোজকের কারণে কিংবা পরিবেশক বা উভয়ের কারণেই। পরিবেশকরা সিনেমাটিকে যথেষ্ট বাণিজ্যিক মনে করেননি। সে কারণে ১০-১৫টা হলে ধরেছিল মাত্র, তাও যে খুব দর্শক পেয়েছিল, তা না। পরে যখন অনলাইনে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করল তখন আমার একদিকে ভালোই লাগল। লক্ষ্য তো দর্শককে দেখানো, ইউটিউবের হিসাবে ৬০-৭০ লাখ লোক ছবিটি দেখেছে।
‘হালদা’র বিষয়বস্তু নদী ও নারী। আপনি চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু কিভাবে ঠিক করেন? ‘অজ্ঞাতনামা’র সময় বলেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের সময় খবরের কাগজের একটি খবর দেখে বিষয়টি ভেবেছিলেন।
আমাকে যে বিষয়টি ভাবায় বা টানে এবং আমার মনে হয় যেটা মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার সেটাই করি। আমাদের এ রকম একটা নদী আছে অথচ আমরা জানি না, নদীটা আবার বিপন্ন হচ্ছে মানুষেরই কারণে, সেটাও খেয়াল করছি না। সেখান থেকে মনে হয়েছিল, এই নদীটাকে অন্তত পরিচিত করে দেওয়া যায় সারা দেশের মানুষের কাছে, হয়তো সবাই নদীগুলোর প্রতি যত্নশীল হবে।
নদী নিয়ে কি আপনার আলাদা আগ্রহ? ‘জয়যাত্রা’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘হালদা’—আপনার সিনেমায় নদী এসেছে বারবার।
নদী ছাড়া বাংলাদেশকে চিন্তা করা যাবে? বাংলাদেশটা তো একটা ব-দ্বীপ। জালের মতো নদী বিছিয়ে আছে দেশের মধ্যে, বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। প্রতিটি সংস্কৃতির বড় জিনিস হচ্ছে তার ল্যান্ডস্কেপ বা ভৌগোলিক অবস্থা। যেমন নেপাল-ভুটানের ছবিতে আমরা কী দেখি? পাহাড়। তেমনই বাংলাদেশের ছবিতে আমি ড্রয়িংরুম দেখতে চাই না। মাঠ, নদী, ফসলের ক্ষেত চাই। আমি ইনডোরের চেয়ে ল্যান্ডস্কেপ ও প্রকৃতির মধ্যে শুট করতে বেশি পছন্দ করি।
সিনেমার শিল্পী নির্বাচন করেন কিভাবে? চরিত্র অনুযায়ী নাকি ভালো অভিনেতা দেখে?
যে যেটা পারবে বা মানাবে তাকে দেই। সে কারণেই আমার ছবিতে ভিন্ন ধরনের অভিনেতারা এসেছেন, যেখানে যাঁকে যেমন দরকার। দু-একজন হয়তো কমন থাকেন, যেমন মোশারফ করিম আমার সব ছবিতেই আছেন, জাহিদ এবারই প্রথম। আগে সেলিম ভাই করেছেন, চঞ্চল করেছেন, মাহফুজ করেছেন।
আপনার সিনেমার সবাই প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা-অভিনেত্রী, কিন্তু ছোট পর্দার। প্রতিদিনই দর্শক যাঁদের টিভিতে দেখতে পায়। টিকিট কেটে তাঁদের প্রেক্ষাগৃহে দেখতে কতটা আগ্রহী হবে দর্শক?
আমি সব সময়ই মনে করেছি আমাদের দেশের টেলিভিশনের অভিনয়ের মানটা অনেক ভালো, অনেক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের চেয়েও ভালো। বড় কারণটা হচ্ছে, তাঁরা সবাই মঞ্চে দীর্ঘদিন অনুশীলন করে তারপর এসেছেন। দর্শকের সামনে যদি ধারাবাহিকভাবে ভালো জিনিসটা তুলে ধরা যায় তাহলেই তার রুচিটাকে ঊর্ধ্বমুখী করা যাবে।
‘হালদা’র চরিত্রগুলো সম্পর্কে যদি ধারণা দেন…
এখন বলতে চাচ্ছি না। ‘হালদা’য় আমরা জনপদের গল্প বলতে চেয়েছি। এখানে যেমন জেলে পরিবারের মানুষও আছে, খেটে খাওয়া মানুষ আছে, যারা ওখানে সুবিধাভোগী সে রকম মানুষও আছে।
শোনা যাচ্ছে, জাহিদ হাসানের চরিত্রটা নেতিবাচক?
হ্যাঁ, সে এখানে উচ্চবিত্তের সুবিধাভোগী লোক।
‘অজ্ঞাতনামা’র সময় প্রেক্ষাগৃহ পেতে যেখানে যুদ্ধ করেতে হয়েছিল সেখানে পরের ছবি ‘হালদা’ মুক্তি পাচ্ছে ১০০টি হলে!
বিষয়টা আনন্দের, তবে একই সঙ্গে বিপদেরও। মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে না মিললে মানে প্রত্যাশা বেশি হয়ে গেলে সেটাও একটা চাপ কিন্তু। তবে এটা আমার কৃতিত্ব না। ১০০ হলে যখন আমাদের ছবি যায় তখন বুঝতে হবে দর্শক অনেকখানি এগিয়েছে, পরিবেশকরা তাদের অবস্থান অনেকখানি বদলেছেন, সেটাই আনন্দের খবর। এই ছবি যদি লগ্নি করা অর্থ ফেরত আনতে পারে তাহলে ইনডিপেনডেন্ট ছবির সংখ্যা বাড়বে।
ট্রেলার মুক্তির পর থেকেই এই সিনেমার ভাষা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। চট্টগ্রামের ভাষা এমনিতেই কঠিন, সারা দেশের মানুষ কতটা বুঝতে পারবে?
এটা নির্দিষ্ট একটা জনপদের গল্প, নির্দিষ্ট সংস্কৃতির গল্প। তাদের সংস্কৃতির উপাদান এখানে এসেছে যেমন নৌকাবাইচ, বলিখেলা, মাইজভাণ্ডারি গান, তেমনি ভাষাটাতেও যদি তাদের অঞ্চলের ছোঁয়া রাখা যায় তাহলে সেটা আরো বিশ্বাসযোগ্য হবে। আমরা ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সচেতন ছিলাম। কারণ আমি অথেনটিক করলাম কিন্তু বোঝা গেল না, তাহলে তো ব্যর্থ হবে জিনিসটা। সুতরাং কঠিন শব্দগুলো বাদ দিয়ে শুধু ওই অঞ্চলের ফ্লেভারটাই রাখার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় না বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে। যদি কারো হয় সে জন্য ইংরেজি সাবটাইটেলও থাকবে।
‘হালদা’র পর কী? শোনা গিয়েছিল জীবনানন্দকে নিয়ে সিনেমা করবেন?
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে সিনেমা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। আসলে এ ধরনের সিনেমার জন্য অর্থ পাওয়া যায় না সেভাবে। এই কাজটা করতে গেলে আমাকে কমপক্ষে বরিশাল, কলকাতা, দিল্লি, ওড়িশা এই চার শহরে শুটিং করতেই হবে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, অর্থ জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত এটা বানানো কঠিন হবে। এরপরের প্রজেক্টের নাম ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটা গল্প, যেটা ২০১৮-তেই করব আশা করি।