যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বোমা হামলার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়া বাংলাদেশী অভিবাসী আকায়েদ উল্লাহ (২৭) উগ্রপন্থী মতাদর্শে দীক্ষিত হন ইন্টারনেট সার্চের মাধ্যমে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরকে আকায়েদ উল্লাহ বলেছেন, তিনি অনলাইনে আল কায়েদার প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘ইন্সপায়ার’ পড়তেন। অনলাইনেই শিখেছেন কীভাবে পাইপ বোমা বানাতে হয়। এ ধরণের একটি পাইপ বোমাই নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধেছিলেন তিনি। যেটি অসময়ে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
খবরে বলা হয়, উগ্রবাদী ওয়েবসাইটে যেতে এনক্রিপশন প্রযুক্তিও ব্যবহার করতে হয় নি তাকে। সাধারণ ব্রাউজার থেকে সার্চ দিয়েই তিনি বিভিন্ন চরমপন্থী লেখার হদিস পান। কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে আটক হওয়া বেশ কয়েকজনও এভাবে সহজেই উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকেছেন। অক্টোবরে, এক উজবেক অভিবাসীর বিরুদ্ধে ট্রাক হামলা চালানোর অভিযোগ গঠন করা হয়। নিউ ইয়র্কে চালানো ওই হামলায় নিহত হন ৮ জন। সরকারি কৌঁসুলিরা বলেছেন, ওই সন্দেহভাজন ব্যক্তিও অনলাইনে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে’র ম্যাগাজিন রুমিয়াহ পড়তেন।
আকায়েদ উল্লাহ কীভাবে উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়েছেন, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। কারণ, দেশটিতে এমন ‘লোন ঔলফ’ বা একক প্রচেষ্টায় হামলা চালানোর প্রবণতা সম্প্রতি বেড়েছে। যদি একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হামলা চালানোর চেষ্টা করে, তাহলে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মধ্যে যোগাযোগ বা আর্থিক লেনদেনের ওপর নজরদারি করে সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় হামলা চালাতে গেলে এসব অত কাজে আসে না।
এ কারণে নিউ ইয়র্ক পুলিশ অনলাইনে উগ্রবাদী উপকরণের সহজলভ্যতার বিষয়ে আপত্তি তুলছে। সংস্থাটি বলছে, গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন কোম্পানি ও গবেষকদের ঘাড়ে এর দায় পড়ে। তাদের উচিত ওই ধরণের উপকরণ তাদের ওয়েবসাইটে না রাখা। নিউ ইয়র্ক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো এ সপ্তাহের শুরুতে বৃহৎ ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর প্রতি এ ব্যাপারে কড়াকড়ি দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ডেপুটি কমিশনার স্টিফেন ডেভিস বলেন, ‘আপনারা একে বাকস্বাধীনতা ভেবে ভুল করছেন। কিন্তু এটি আদতে তা নয়। এটি পানির মতো পরিষ্কার যে, এসব উপকরণ ছড়ানোর একটাই শুধু কারণ থাকতে পারে। আপনি এই যুক্তি দেখাতে পারেন না যে, বিজ্ঞানীরা এসব কলাকৌশল শিখতে চাইতে পারে।’
চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ আরন জেলিন আবার ‘জিহাদোলোজি’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালান। এই ওয়েবসাইটে জঙ্গিদের বিভিন্ন ম্যাগাজিন পোস্ট করা হয়। তিনি পুলিশের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তার ভাষ্য, ‘বেশিরভাগ জিহাদি প্রয়োজনীয় জ্ঞান পায় জঙ্গিদের কথাবার্তা থেকে।’ ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি নামে একটি থিংকট্যাংকে কর্মরত জেলিন আরও বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, আমি যদি এসব উপকরণ আমার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা বন্ধও করি, সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানোর চেষ্টা বা পরিকল্পনা কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে না।’
জেলিনের ওয়েবসাইট সহ অনেক গবেষকের ওয়েবসাইটেই আল কায়েদার ইন্সপায়ার ম্যাগাজিনের একটি ইস্যু পোস্ট করা আছে। সেখানে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম হলো, ‘রান্নাঘরে বসেই বানিয়ে ফেলুন বোমা।’ এই অধ্যায়ে বিস্তারিত বলে দেওয়া আছে যে, কীভাবে খুব সহজেই হাতের কাছে পাওয়া উপকরণ দিয়ে বোমা বানানো সম্ভব। এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আকায়েদ উল্লাহ যে বোমা বানিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ওই অধ্যায়ে বর্ণিত বোমার মিল আছে। ম্যাগাজিনে পরামর্শ দিয়ে বলা আছে, বড়দিনের ট্রি লাইটকে বোমার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে। আকায়েদ উল্লাহর বোমায় ঠিক সেই ধরণের একটি লাইট ব্যবহার করা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক পুলিশের সাবেক সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী সহকারী কমিশনার ডেভিড কেলি বলেন, হামলা চালানোর নির্দেশনা সম্বলিত লিখিত উপকরণ অনলাইনে অনেক দিন ধরেই সহজে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য অ্যানার্কিস্ট কুকবুক’ বইয়ে বোমা বানানোর নির্দেশনা বিস্তারিত দেওয়া আছে। বর্তমানে বেসরকারী গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান কে২ ইন্টিলিজেন্সে কর্মরত কেলি বলেন, ‘যেসব স্থানে রাখলে মানুষ আকৃষ্ট হবে, সেখানে নিজেদের জিনিসপত্র রেখে আসতে পটু জিহাদীরা।’ তিনি সংশয় প্রকাশ করে বলেন, এসব জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে বিভিন্ন ওয়েবসাইটকে বাধ্য করতে আন্দোলন হবে বলে তিনি মনে করেন না। অন্যরা বলতে পারেন, এর সঙ্গে বাকস্বাধীনতার প্রসঙ্গ জড়িত। তিনি মনে করেন, তার চেয়ে ভালো হবে যদি সন্ত্রাসীদের বার্তাকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা বক্তব্য অনলাইনে পোস্ট করা হয়।
ক্ল্যারিওন প্রজেক্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানও উগ্রবাদী বিভিন্ন ম্যাগাজিন তাদের ওয়েবসাইটে রাখে। এই প্রতিষ্ঠানটি চরমপন্থার বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে। ক্ল্যারিওনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক রায়ান মাওরো বলেন, ‘অনলাইনের মতাদর্শগত যুদ্ধ লড়ার ক্ষেত্রে স্ব-আরোপিত অজ্ঞতা ভালো কৌশল হতে পারে না।’
গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনে উগ্রপন্থী জিনিসপত্রের জন্য সার্চ দিলে ক্ল্যারিওন বা জিহাদোলজি’র মতো ওয়েবসাইটই সবার আগে আসবে। কারণ, গুগল চরমপন্থীদের ওয়েবসাইটের চেয়ে চরমপন্থা প্রতিরোধে কাজ করছে এমন ওয়েবসাইটগুলোকেই র্যাংকিং-এ উপরের দিকে রাখে। এ কারণে, যেসব ওয়েবসাইট চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়ছে, সেগুলোই হয়ে উঠেছে চরমপন্থী উপকরণ পাওয়ার সবচেয়ে সহজ জায়গা।
গুগল বলেছে, এ ধরণের ক্ষেত্রে শুধু রোবটের ওপর নির্ভর না করে মানুষকেও নিয়োগ দিয়েছে তারা। এছাড়া সফটওয়্যার আধুনিকায়নেও কাজ করেছে তারা। এ কারণেই ইউটিউব থেকে চরমপন্থী ভিডিওগুলো প্রত্যাহার করা অনেকাংশে সম্ভব হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক পুলিশের কর্মকর্তা স্টিফেন ডেভিস বলছেন, জঙ্গিগোষ্ঠীদের ম্যাগাজিন পুরোপুরি না সরালেও, অন্তত বোমা তৈরি বা ট্রাক হামলার কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে, এ ধরণের অধ্যায় যাতে সরিয়ে ফেলা হয়। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কিন্তু এ ধরণের চরমপন্থী বক্তব্য ফিল্টার করতে সক্ষম হয়েছে।