বর্মী বাহিনীর বর্বর নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে রাখাইন ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমে ফিরিয়ে নিতে মাঠ পর্যায়ের চূড়ান্ত চুক্তি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সই করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে গতকাল মিয়ানমারের রাজধানী নেপি’ডতে ওই চুক্তি সই হয়। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ও মিয়ানমারের স্থায়ী সচিব মিন্ট থো’র নেতৃত্বাধীন ৩০ সদস্যের ওয়ার্কিং গ্রুপ গত দু’দিন বিস্তৃত
আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, গত ২৩শে নভেম্বর সই হওয়া দ্বিপক্ষীয় ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’র ধারাবাহিকতায় ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’টি সই হয়েছে। আগের চুক্তি মতে, ২৩শে জানুয়ারির মধ্যে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের বাসিন্দাদের ফিরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হওয়ার কথা। আর গতকাল সই হওয়া ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি অবশ্য ২৩শে জানুয়ারির পূর্ব নির্ধারিত ডেটলাইনের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গতকাল তিনি বলেন, ২৩শে জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া উচিত (ফ্রাস্ট লট সোড বি গয়িং)। তবে তাতে সপ্তাহ বা দু’একদিন এদিক-ওদিক হতে পারে। তার মতে, একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হিউম্যানলি যে সময় লাগে সেটিই নেয়া হবে, এর চেয়ে বেশি নয়। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রত্যাবাসন না হলেও ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই এটি শুরু হবে- এমন ধারণা দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই আছি। আমরা স্বেচ্ছায়, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে চাই। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক এবং ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট সইয়ের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আন্তরিক পরিবেশে’ অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। যা তৈরি করা হয়েছে আগে সই হওয়া সম্মতিপত্র এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের দলিলের (টার্মস অব রেফারেন্স) ভিত্তিতে। গত ২৫শে আগস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে এসেছে ৮৭ হাজার। গত কয়েক দশকের বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় রয়ে গেছে। প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছে। তবে নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তি মতে ২০১৬ সালের পর আসা রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাই করে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। সে মতে, ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরানোর কথা। বাকিদের বিষয়ে ফের আলোচনা হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এও জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য একটি ফরমও চূড়ান্ত করা হয়েছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে। ঠিক হয়েছে, পরিচয় যাচাই ও প্রত্যাবাসনের কাজটি হবে প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে। অনাথ ও ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়’ জন্ম নেয়া শিশুদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চুক্তি মতে, সীমান্তের পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে তাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে। পরে সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভিটামাটিতে দ্রুততার সঙ্গে বাড়িঘর পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা নেবে মিয়ানমার। প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে থাকা কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। গতকালের বৈঠকে মিয়ানমার ফের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা তাদের বাসিন্দাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেবে। রোহিঙ্গাদের যাচাই এবং প্রত্যাবাসন কাজের সুবিধার জন্য দুটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের বিষয়েও দুই পক্ষ একমত হয়েছে।
রাষ্ট্রদূত যা বললেন- এদিকে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান গণমাধ্যমে দেয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে একটি ভালো চুক্তি হয়েছে। যা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা বলেছি যখন থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে তার দুই বছরের মধ্যে ‘প্রেফারেবলি’ এটি শেষ হবে। এটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং মিয়ানমার এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছিলাম প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবো। কিন্তু তারা ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারা নিজেরা রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করেছে। ফলে প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিদিন ৩০০ করে সপ্তাহে এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে পর্যালোচনা করে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে। রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এই ব্যবস্থার অধীনে একটি পরিবারকে একটি ইউনিট হিসেবে গণ্য করা হবে অর্থাৎ একটি ফরমে পুরো পরিবারের তথ্য থাকবে এবং মিয়ানমার এটি গ্রহণ করবে। ফলে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে বাংলাদেশ কাজে লাগাবে এবং মিয়ানমার তাদের সময়মতো বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করবে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে আর না আসে তার ব্যবস্থা করবে মিয়ানমার। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সীমান্তে অপেক্ষমাণ ৭ হাজার রোহিঙ্গাকে তারা সেখান থেকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখবে এবং এটি কখনোই ইন্টারনালি ডিসপ্রেসড ক্যাম্পে পরিণত হবে না বলে মিয়ানমার জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের তালিকা কবে দেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যত শিগগিরই সম্ভব তালিকা দেয়া হবে।