স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ গতকাল শুক্রবার গিয়েছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায়। ইচ্ছে এই সিটির নির্বাচনী কর্মকাণ্ড কেমন হচ্ছে, তা সরেজমিনে দেখা। ঘুরেছেন-দেখেছেন।
কেমন দেখলেন নির্বাচনী পরিবেশ? প্রথম আলোর এই প্রশ্নের জবাবে ড. তোফায়েল বললেন, এখন পর্যন্ত ভালো। এই পরিবেশ ধরে রাখা গেলে নির্বাচন ভালো হবে। তবে তিনি এও বললেন, ‘বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে কিছু অভিযোগ করা হয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে কমিশনকে দৃশ্যমান কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে সবার মধ্যে আস্থা ফিরবে। কিন্তু হাসান সরকার আমাকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত কমিশন থেকে তাঁকে কিছু বলা হয়নি।’
সিটি এলাকার ভোটারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বললেন, ‘এখানে নির্বাচন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাই কেবল মাঠে আছেন। অর্থাৎ বিভিন্ন দলের নেতা–কর্মী ও নির্বাচন–সংশ্লিষ্টদের এলাকায় দেখা যাচ্ছে। ভোটারদের সেখানে দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা সরাসরি কোনো কিছুতেই অংশ নিচ্ছেন না। তাই ভোটারদের মনোভাব এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তা ছাড়া যেটা দেখলাম প্রধান মেয়র প্রার্থীরা সড়ক ও সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে পথসভা ও প্রচারণা করছেন। এটা অনেকটা মহড়ার মতো। তাঁরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন না। ফলে তাঁরাও ভোটারদের মনোভাব বুঝতে পারছেন না। আমার কথা বলে এমনটাই মনে হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাজীপুর একটা মেট্রোপলিটন শহর; পাশাপাশি শিল্প শহরও বটে। এখানকার ভোটারদের বৈশিষ্ট্য বিচার করাটা কঠিন। এ কারণে কোনো প্রার্থীর পক্ষেই সে কত ভোট পাবে এমন হিসাব-নিকাশ করাটা সহজ নয়।’
ভোটারদের বৈশিষ্ট্য বিচারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে অনেকটাই একমত আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান সরকার। দুজনই জয়ের ব্যাপারে ‘শতভাগ’ আশাবাদী হলেও ভোটারদের আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করতে চান না। ভোটারদের ভোটার হিসেবেই দেখছেন তাঁরা। বলছেন, সব শ্রেণির ভোটারদের ভোটই পাবেন। সবার কাছেই যাচ্ছেন।
প্রার্থীরা প্রকাশ্যে ভোটারদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে ভোটের হিসাব-নিকাশের কথা না বললেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটারদের প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করেছেন। ভোটারদের এই ভাগের মধ্যে আছেন সিটি করপোরেশন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, অস্থায়ী বাসিন্দা, শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তরুণ ভোটার, সিটি করপোরেশনের এলাকাভিত্তিক ভোটার।
স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা বলছেন, প্রতিটি ভাগেই প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরে ছোট দলগুলোরও কিছু কিছু ভোট আছে। কোন দলের মেয়র প্রার্থীকে ভোট দেবেন—এমন সিদ্ধান্ত মোট ভোটারের কমপক্ষে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আগেই নিয়ে রেখেছেন। এদের মনোভাব পরিবর্তন করে ভোট বাড়ানো কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব হবে না। মূলত, বাকি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোটার, যাঁরা ‘ভাসমান ভোটার’ হিসেবে পরিচিত, তাঁদের নিয়েই সেখানে হিসাব–নিকাশ করছেন প্রার্থীরা। এই ভোটারদের মধ্য থেকে যিনি যতটা নিজের দিকে টানতে পারবেন, তিনিই জিতবেন।
গাজীপুর সিটির মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। ভোটার হিসাবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে মোট আটটি বিশেষ অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আছে কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, বাসন, কাউলতিয়া, গাজীপুর পৌর এলাকা, গাছা, পুবাইল ও টঙ্গী।
আটটি বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে টঙ্গীতে মোট ভোটার ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫২। অর্থাৎ মোট ভোটারের ৩২ শতাংশ টঙ্গীর। বাকি সাত অঞ্চলের কোনোটিরই ভোটার দেড় লাখও পার হয় না। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটার গাছায় ১ লাখ ৪৭ হাজার এবং তৃতীয় কাশিমপুরে ১ লাখ ১৬ হাজার জন। সবচেয়ে কম ভোটার পুবাইলে ৬০ হাজার।
আটটি বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে টঙ্গীতে বিএনপি প্রার্থীর বাড়ি হওয়ায় সেখানে তিনি বেশি ভোট পাবেন বলে স্থানীয় লোকজন মনে করছেন। গাছা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরে আওয়ামী লীগের ভোট বেশি। বাকি এলাকাগুলোতে দুই প্রার্থী সমানে সমানে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
টঙ্গীতে ভালো করলে নির্বাচনে ভালো হবে—এ বিশ্বাস শুধু বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগেরও আছে। তাই এলাকাটিতে বিএনপির মতো বিশেষ নজর আছে শাসক দলেরও।
এলাকার বাইরে সংখ্যালঘু ভোটারদের একটি বড় ভূমিকা নির্বাচনে থাকছে। বিভিন্ন হিসেবে এই সিটি ৮ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সংখ্যালঘু ভোটার আছে। অর্থাৎ প্রায় এক লাখের মতো ভোটার রয়েছে। আওয়ামী লীগ এই ভোটারদের বেশির ভাগ ভোট পাবে বলে বিশ্বাস করে।
বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংগঠন এবং জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) এর কিছু ভোট রয়েছে। এই সংখ্যা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো। এর মধ্যে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর বাইরে জামায়াতে ইসলামের কিছু ভোট আছে। এটা সংখ্যায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এই ভোটগুলো বিএনপির প্রার্থীর পক্ষেই যাবে। আজ জাতীয় পার্টির ভোট আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রার্থীই কমবেশি পাবেন।
গাজীপুরে মোট ভোটারের এক–চতুর্থাংশই শ্রমিক ভোটার। অর্থাৎ প্রায় তিন লাখ ভোটার শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ। এই ভোটারদের দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর ও বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকার। সে কথা স্বীকারও করলেন দুই প্রার্থী ও তাঁদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।
ইতিমধ্যে ঈদ করে গাজীপুরে ফিরেছেন বেশির ভাগ শ্রমিক। ২৪ তারিখের মধ্যে সব কারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ শ্রমিকই ভোটের দিন এলাকাতেই থাকবেন। অবশ্য নির্বাচন কমিশন সূত্র ও নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত দুই দলের নেতারা বলছেন, শ্রমিকের স্থান পরিবর্তন করেন। এ কারণে ভোটার তালিকায় নাম থাকা সব শ্রমিক এখন ওই এলাকায় নেই। স্থান পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। তা ছাড়া জেলার ছয় হাজার কারখানার মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে প্রায় দুই হাজার কারখানা রয়েছে। ফলে ভোটার তালিকায় নাম থাকা অনেক শ্রমিক কারাখানা পরিবর্তনও করেছেন। ৪০ থেকে ৪৫ হাজার শ্রমিক ভোটার এখন এলাকায় নেই।
গতকাল শুক্রবার কথা হয় বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে। প্রকাশ্যে ভোটাররা ভোট দেওয়ার ‘তাত্ত্বিক’ কারণই বলছেন। কাকে ভোট দেবেন জানতে চাইলে তাঁদের উত্তর, যিনি ভালো কাজ করবেন, তাঁদের পাশে থাকবেন, মানুষ ভালো, সৎ, যাঁর কাছে যাওয়া যাবে এবং এলাকার উন্নয়ন হবে—এমন লোককে তাঁরা ভোট দেবেন। সত্তরোর্ধ্ব মোস্তফা নামের পুবাইল বাজারের এক চায়ের দোকানদারের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল, জীবনে যত ভোট দিয়েছেন, এমন লোক কি একবারও পেয়েছেন? উত্তরে বললেন, সেভাবে পাননি। তাহলে প্রতিবারই কি ভোট দেন? ‘হ্যাঁ দিই।’ কেন দেন? কিছুটা ভেবে বললেন, ‘ভোট তো দিতেই হবে। তাই দিই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়দেবপুরের একটি স্কুলের শিক্ষক বললেন, বেশির ভাগ ভোটারই ঠিক করে রেখেছেন কাকে ভোট দেবেন। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই ভোটটা হবে মূলত সরকারি দলের সমর্থক ও সরকারবিরোধীদের। এখানে অন্য কিছু কাজ করবে না। তার মানে শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই মালিক ও শ্রমিকনেতাদের কথায় ভোট দেন। এমনটা দেখা গেছে।
ভোটারদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। তিনি বলেন, তাঁর লক্ষ্য ভোটারদের কেন্দ্রে আনা। তাহলেই বিপুল ভোটের তিনি জয় পাবেন। তিনি বলেন, ভোটাররা নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। তাঁর নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সেটি বিবেচনায় রাখছেন।
আর বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকার বলছেন, তিনি টঙ্গীর পৌর মেয়র ছিলেন। দুবার জাতীয় পার্টির সাংসদ ছিলেন। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। এলাকার মানুষ তাঁকে চেনে–জানে। তিনিও তাদের পাশে সব সময় থাকার চেষ্টা করেছেন। ভোটারেরা কেন্দ্রে গেলে তিনি বিপুল ভোটে জয় পাবেন।