গৃহযুদ্ধ চলাকালে হত্যাযজ্ঞকে ধামাচাপা দেয়ার অপরাধে শ্রীলঙ্কার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা (চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ) রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নে’কে জেলে পাঠানো হয়েছে। তিন দশকের গৃহযুদ্ধের শেষ কয়েক মাসে ১১ জন তরুণ, যুবক নিখোঁজ হন। অভিযোগ আছে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এর জন্য প্রধান অভিযুক্ত নৌবাহিনীর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তাকে সুরক্ষা দিয়েছলেন রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নে। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কয়েকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আদালতে হাজির হন নি। এমন কি পুলিশে ধরা দেন নি।অবশেষে বুধবার তাকে আটক করে পুলিশ। ওই ১১ তরুণ বা যুবককে ‘হত্যা’র অভিযোগ নিয়ে যে মামলা আছে তার একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে তিনি গত সপ্তাহান্তে অপহরণের চেষ্টা করেন। এর পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন দ্য গার্ডিয়ান।
শ্রীলঙ্কায় সেনাবাহিনীর এ যাবতকাল যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ পদের অধিকারী। বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইটারদের বিরুদ্ধে দেশটিতে ২৬ বছর ধরে চলে গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে তিনি ওই অপরাধ করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে এ নিয়ে বিচার চলছে। চলছে তদন্ত। আদালতের শুনানিতে বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে শেষ সময়ে যে গৃহযুদ্ধ হয় সে সময়ে নৌবাহিনীর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ১১ জন তরুণ ও যুবককে অপহরণ করেছিলেন। এর পর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। তাই অভিযোগ আছে, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার জন্য নৌবাহিনীর অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তাকে পালাতে সহায়তা করেছেন রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নে। তদন্তকারীরা বলছেন, ওই যুবকদের অপহরণকারী চন্দনা প্রসাদ হেতিয়ারাচ্ছি। তিনি যে ১১ যুবককে অপহরণ করেছিলেন তার বেশির ভাগই তামিল। আটক রেখে তাদের সম্পদশালী পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু ওই যুবকদের আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে এই নিখোঁজ ঘটনায় রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নের নাম উঠে আসে নি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওই নিখোঁজের জন্য দায়ী কর্মকর্তা প্রসাদ হেতিয়ারাচ্ছিকে গ্রেপ্তার এড়াতে মালয়েশিয়া পালাতে সহায়তা করেছেন তিনি। পরে তিনি গত আগস্টে শ্রীলঙ্কা ফেরেন এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওদিকে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ডজন ডজন বেসামরিক মানুষকে অপহরণ করার অভিযোগ ডকুমেন্ট আকারে হাজির করেছে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। বলা হয়েছে, তাদেরকে অপহরণ করেছে সেনাবাহিনী এবং তাদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে তারা। এ ছাড়াও গৃহযুদ্ধকালে আরো বিভিন্ন রকম অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে ‘অফিস অব মিসিং পারসনস’। তাদের হিসাবে যুদ্ধের শেষের দিকে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। তাদের বিষয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। ওদিকে অনিয়ম বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে দায়ী সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিচার করার দাবি শ্রীলঙ্কায় পর্যায়ক্রমিক সরকারগুলো অস্বীকার করে এসেছে। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জড়িত সন্দেহভাজনদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠার দাবিও অগ্রাহ্য করেছে দেশটি। তবে অল্প কয়েকটি মামলা হাতে রাখা হয়েছে।
এরই অধীনে রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নের বিরুদ্ধে তিনটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এ মাসে। এই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার বহুল বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও আদালতে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নে। উল্টো তিনি সরকারের একজন দূত হিসেবে মেক্সিকো সফরে যান। কিন্তু এ সপ্তাহে একটি নতুন তথ্য সামনে আসে। তাতে বলা হয়, ওই ১১ যুবক নিখোঁজের ঘটনায় একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শী একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডারকে হুমকি দিয়েছেন রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নে ও নৌবাহিনীর ৫ জন কর্মকর্তা। এর পরই বুধবার পুলিশ গ্রেপ্তার করে রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নেকে। বুধবার কলম্বোতে ম্যাজিস্ট্রেট রাঙ্গা দসানায়েকের আদালতে রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নেকে হাজির করা হয়। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে বলেন, আপনার জামিন আবেদন আমি প্রত্যাখ্যান করছি। কারণ, আপনি আপনার পদ ব্যবহার করে প্রত্যাক্ষদর্শীকে প্রভাবিত করতে পারেন। বিঘিœত করতে পারেন তদন্ত।
এ সময আদালতে পূর্ণ সামরিক পোশাকে দেখা গেছে রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নেকে। তা নিয়েও মন্তব্য করেন আদালত। বলেন, এ পোশাক দিয়ে আদালতকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নের সঙ্গে আদালতে সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা, সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকরা তাদের ছবি তুলতে গেলে তারা তাদের ওপর হামলা চালায়। এ অভিযোগে নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওদিকে আদালতে রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আইনজীবির মাধ্যমে অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, তারা জামিন আবেদন করবেন। আদালত রবীন্দ্র বিজেগুনারত্নেকে আগামী ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।