সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (সোশ্যাল মিডিয়া) ফেসবুকে সরকারপন্থি পোস্ট করার জন্য বাছাই করা নাগরিকের তালিকা করেছিল ভিয়েতনাম সরকার। গুয়াতেমালা সরকার বিরোধী মত দমনের জন্য নাগরিকদের একাউন্ট হ্যাক করেছিল। ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন দল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রচারণা চালাতে লোক নিয়োগ দিয়েছিল। ফেসবুকের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এধরনের প্রচারণা চালিয়েছে অন্তত ৭০ দেশ। গত বৃহস্পতিবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, এরকম প্রচারণা চালানো প্রত্যেকটি দেশেই অন্তত একটি রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাসীন সরকার নিজস্ব স্বার্থে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ দল ও সরকার কর্তৃক গুজব ছড়ানো নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউট বিভাগের গবেষকরা। এতে বলা হয়, ভুয়া খবর ছড়ানো ঠেকাতে সদা তৎপর রয়েছে ফেসবুক, টুইটার ও সামাজিক অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হেয় করতে, নিজেদের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে, বিরোধীদের দমাতে এসব পন্থা অবলম্বন করছে বিভিন্ন সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি তথ্য বিকৃতির শিকার হয়েছে ফেসবুক। প্ল্যাটফর্মটিতে সংগঠিত অপপ্রচার অভিযান চালিয়েছে অন্তত ৫৬টি দেশ। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউটের এক গবেষক সামান্থা ব্র্যাডশ বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন উপায়ে অপপ্রচার ও গুজব ছড়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে ফেসবুক ছাড়া টুইটার ও ইউটিউবে অপপ্রচার চালানোর তথ্যও ওঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এধরনের গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তবে গবেষণায় দেখা যায়, অপপ্রচারের কৌশল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে বট ব্যবহার করা, ভুয়া একাউন্ট খুলে পোস্ট করা, ট্রোল ব্যবহার করা। বিগত দুই মাসে প্ল্যাটফর্মগুলো চীন ও সৌদি আরব সংশ্লিষ্ট একাধিক সন্দেহজনক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষণকারী সংগঠন গ্রাফিকা’র তদন্ত বিষয়ক পরিচালক বেন নিমো জানান, ২০২০ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগ দিয়ে ইন্টারনেটে তথ্য বিকৃতির হার বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী পরিচয় গোপন রেখে এসব প্রচারণা চালাচ্ছে। গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল সেসবের ওপর ভিত্তি করে নতুন পদ্ধতিতে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
তথ্য বিকৃতির ক্ষেত্রে নতুন করে বিশ্বে প্রভাব ফেলছে চীন। বহুদিন ধরে দেশীয় পর্যায়ে তারা গুজবের ব্যবহার করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাদের অপপ্রচার বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে। এ ধরনের অপপ্রচার চালানোর জন্য আলাদাভাবে জোর দিচ্ছে চীন কর্তৃপক্ষ। আগস্ট মাসে হংকংয়ের বিক্ষোভ নিয়ে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে কয়েকশ’ চীনা একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব।
প্রতিবেদন অনুসারে, তথ্য বিকৃতিতে পেশাদার ভাব চলে আসছে। সংগঠিত উপায়ে এসব কাজকর্ম করা হচ্ছে। সরকাররা ‘সাইবার সেনা’ নিয়োগ করছে, নিজদের স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে। জনমত পাল্টে দিতে ব্যবহার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। দেশ ছেড়ে এখন আরো বিস্তৃত পর্যায়ে শুরু হয়েছে অপপ্রচার চালানো। অঞ্চল বা অঙ্গরাজ্য ভিত্তিতেও এসব অভিযান চালানো হচ্ছে। অক্সফোর্ড গবেষকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকাররা মানবাধিকার লঙ্ঘন চাপা দেয়া, ভিন্নমত দমন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করা হচ্ছে। আজারবাইজান, বাহরাইন ও জিম্বাবুয়েতে এই হার বেশি। এছাড়া, তাজিকিস্তানে ভুয়া একাউন্ট খুলে সরকারপন্থি প্রচারণা চালাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। মিয়ানমারেও একইরকম ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের জনগণের মত পাল্টাতে এ ধরনের অভিযান চালিয়ে থাকে সরকাররা। তবে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, ভারত, সৌদি আরব ও ভেনেজুয়েলা তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতেও এসব অপপ্রচার চালিয়েছে।