।তেহাত্তর সালটি শুরু হয়েছিল একটি দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ঢাকার তোপখানা রোডে ছাত্র ইউনিয়ন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী একটি কর্মসূচি পালন করার সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের (ইউএসআইএস) সামনে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র মির্জা কাদিরুল ইসলাম নামে দুজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী নিহত হয়। গুলিতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসু বাংলাদেশে সব মার্কিন প্রচার ও তথ্যকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণার দাবি জানায় এবং দায়ী মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলে। পরে জানা যায়, পয়লা জানুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের পেছনে ছাত্র ইউনিয়নের উসকানি ছিল। মিছিল থেকে ককটেল ছোড়া হতে পারে এই আশঙ্কায় পুলিশ মারমুখী হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে দলের উর্ধ্বতন নেতাদের জ্ঞাতসারেই ইউএসআইএস ভবনসংলগ্ন ন্যাপ অফিসের ছাদে বসে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বোমা তৈরি করেছিল।
ইউএসআইএস ভবন আক্রমণের লক্ষ্যেই ছিল এই আয়োজন। পরে এটা জানতে পেরে সিপিবি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সেলিমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
লেখক, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদের সদ্য প্রকাশিত ‘বেলা-অবেলা: বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫’ বইয়ে এ বিবরণ পাওয়া যায়। মহিউদ্দিন আহমদ আরো লিখেছেন, ২রা জানুয়ারি ১৯৭৩ পল্টনে এক জমায়েতে ডাকসুর সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান ১৯৭২ সালের ৬ই মে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ বাতিলের ঘোষণা দেন। ৩রা জানুয়ারি হরতাল পালিত হলো। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের উল্টোদিকে গোলচত্বরে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। শিল্পী-সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদসভা ডাকেন বেগম সুফিয়া কামাল, জসীমউদ্দীন, রাণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষগুপ্ত, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, কামরুল হাসান, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, সরদার ফজলুল করিম, সন্জীদা খাতুন, জাহেদুর রহিম, সৈয়দ হাসান ইমাম, কায়সুল হক, আলী আকসাদ, বজলুর রহমান, সাইফুদ্দৌলা, ইকরাম আহমদ, আরিফুল হক। এদের আহ্বানে সভা ও মিছিল হয়।
৪ জানুয়ারি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ব্যানার নিয়ে একদল লোক তোপখানা রোডে ন্যাপের অফিসে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়নের অফিসও আক্রান্ত হয়। পাল্টা আক্রমনে দিশেহারা হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ তাদের আন্দোলনের ইতি টানে। ১ জানুয়ারি পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনার সংবাদ ফলাও করে বিকেলে একটি বিশেষ সংখ্যা ছেপেছিল সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলা। পত্রিকাটির ওপর খড়গ নেমে আসে। ৬ জানুয়ারি সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান এবং নির্বাহী সম্পাদক তোয়াব খানকে দৈনিক বাংলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।