কেশোয়ারা সুলতানা সাথীর বুটিক পরিডটকমের বয়স চার বছর। মিরপুরে দোকান আছে, অনলাইনেও ভালো চলে তাঁর পণ্য। হঠাৎ সন্ত্রাসী শাহাদত পরিচয়ে ফোন ভড়কে দিয়েছে তাঁকে। পরে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি তাঁর মতো আরও বেশ কিছু নারী উদ্যোক্তা।
কেশোয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত নম্বরেই ২৬ অক্টোবর এসেছিল ফোন। নিজেকে শাহাদত বলে পরিচয় দিয়ে একজন জানতে চাইলেন, তাঁর পাঠানো “আর্মড” লোকটা দোকানের সামনে আছে কি না।’ কেশোয়ারা কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এরপর তিনি জানতে চান সশস্ত্র লোক তাঁর দোকানে আসতে যাবে কেন? জবাবে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি বলেন, টাকাপয়সা চায়। কেশোয়ারা জবাবে বলেন, করোনার কারণে তাঁর ব্যবসাই ক্ষতিতে পড়েছে। তিনি কী করে চাঁদা দেবেন। সন্ত্রাসী শাহাদত পরিচয়ে ফোন করা ব্যক্তি তখন করোনার আগের রোজগার কোথায় গেল জানতে চান। ওই ব্যক্তি নিজের বিভিন্ন কীর্তির কথাও বলতে থাকেন। একপর্যায়ে ফোন ছেড়ে দেন কেশোয়ারা।
বিজ্ঞাপন
ওই ফোনটা রেখেই কেশোয়ারা অন্য নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানতে পারেন, একই ধরনের হুমকি পেয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। যশোরের নাহিদা বানুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অপরাজিতা বাইরি নামের একটি বুটিকের ব্যবসা আছে নাহিদার। বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করেন আবার তাঁর কিছু নির্ধারিত ক্রেতা আছেন। তাঁরা পাইকারি জিনিসপত্র কেনেন। নাহিদাকে সর্বহারা পরিচয়ে ফোন দিয়েছেন এক ব্যক্তি। শ্লেষের সুরে তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালোই আছ। তা ব্যবসা কেমন চলে? আয়-রোজগার তো নিশ্চয়ই ভালো।’ নাহিদার এক ভাই সশস্ত্র বাহিনীতে আছেন। তিনি তাঁর পরিচয় দিয়ে কোনো রকমে ফোন ছাড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে নারী উদ্যোক্তারা সম্প্রতি এই সমস্যায় পড়েছেন, তাঁরা সবাই এসএমই ফাউন্ডেশনের নানা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা বিভিন্ন সময় এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বা মেলায় দোকান দিয়েছিলেন। এসএমই ফাউন্ডেশন জাতীয় ও আঞ্চলিক মেলায় নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করে থাকে। গত মার্চেও এমন একটি মেলা হয়েছিল। মেলা উপলক্ষে যে স্যুভেনির বেরিয়েছিল, সেখানে অংশগ্রহণকারী নারীদের নাম, ঠিকানা ও ছবি রয়েছে। উদ্যোক্তাদের ধারণা, এই স্যুভেনির ধরে ধরেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে সন্ত্রাসী ও প্রতারকেরা।
উদ্যোক্তাদের অনেকে প্রতারণার শিকারও হয়েছেন। কেউ কেউ অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। রোকেয়া বেগম নামের এক উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করেই করোনার মধ্যে তাঁর কাছে বেশ কিছু ফোন আসে। খুব আন্তরিকভাবে একজন বলেন, তিনি তাঁকে কিছু ঋণের ব্যবস্থা করে দেবেন। শুধু তা-ই নয়, বিদেশে তাঁর পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থা করিয়ে দেবেন। রোকেয়া বেগম একটু ধাক্কা খান। তিনি কারও কাছে ঋণের জন্য যাননি। করোনার কারণে ব্যবসা মন্দা, তবুও যাননি কোথাও। ওই ব্যক্তি তাঁকে ১২০০ টাকা বিকাশ করে পাঠাতে বলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত টাকাটা দেননি। কেয়া বুটিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি।
প্রতারকেরা রাজশাহী উইমেন চেম্বারের সভাপতি মনিরা মতিন জোনাকীকেও ফোন করেছিল। একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের প্রধানের ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে এক ব্যক্তি তাঁকে ফোন করেন। তিনি পাল্টা তাঁকে বলেন, ব্যাংকের প্রধান তাঁর পূর্বপরিচিত। ব্যক্তিগত সহকারীকে দিয়ে ফোন করানোর কথা নয়। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রাজশাহীর আরও কিছু নারী উদ্যোক্তার কাছে ১২০০ টাকা বিকাশ করে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করেছে প্রতারক চক্র।
বিজ্ঞাপন
আফসানা খন্দকারের কাছে ফোন এসেছিল একটি বড় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তার নামে। আফসানার অবশ্য ঋণের দরকার ছিল। জুন-জুলাইয়ের দিকে বিসিক তাঁদের ঋণ পাইয়ে দেবে বলে ডেকেও ছিল। ফোনটা পেয়ে তিনি সত্যিই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু কথাবার্তার একপর্যায়ে ওই কর্মকর্তা টাকা বিকাশ করার দাবি থেকে সরে এসে তাঁর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ও ঘোরাফেরার প্রস্তাব দেন। আফসানা বলে দেন, তাঁর ঋণের প্রয়োজন নেই।
টপ লেভেল ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কানিজ ফাতেমাকে অবশ্য এসএমই ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তার নামেই ফোন করেছিল প্রতারক। তিনি ফোনটা রেখেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন যে প্রতারক এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়েছেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের মেলা কমিটির ব্যবস্থাপক আব্বাস আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে তিনি উদ্যোক্তাদের সতর্ক করেছেন। বিজ্ঞপ্তিও ছেপেছেন। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার চাঁদাবাজদের হুমকির কথা জানিয়ে তিন উদ্যোক্তা তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা এখন বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।