অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে নিশ্চয় সবাই চেনেন। হলিউডের এই তারকা তাঁর অভিনয়গুণে বিশ্বজুড়ে এখন বহুল পরিচিত। বাংলাদেশেও তাঁর ভক্তকুলের অভাব নেই। তবে এই তারকা যে পরচুলা ব্যবহার করেন, এটা জানেন কি?
র্যাংকার নামের একটি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পরচুলা ব্যবহারে বিশ্বতারকাদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে জোলির নামটি। শুধু অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নন, বিশ্বতারকাদের অনেকেই এখন ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে পরচুলা ব্যবহার করেন।
অবশ্য শুধু পরচুলা নয়, ফ্যাশনের জন্য এখন কৃত্রিম ভ্রু ও চোখের পাতার লোমের ব্যবহারও ক্রমেই বাড়ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। আর কৃত্রিম এসব উপকরণ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশেও। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে এসব উপকরণের রপ্তানিও বাড়ছে। ফ্যাশনের প্রয়োজনে মানুষ ছাড়াও পরচুলার বহুল ব্যবহার রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পুতুলে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মার্কিন ডলারের পরচুলা, কৃত্রিম ভ্রু ও চোখের পাতার লোম রপ্তানি হয়েছে। ডলারের বিনিময় মূল্য ৭৭ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় রপ্তানির এই পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় নয় কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাংলাদেশে এসব পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে চারটি। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা বা ইপিজেডে। তিনটি প্রতিষ্ঠানই চীনের মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উত্তরা ইপিজেডে রয়েছে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস, ঈশ্বরদীতে এমজেএল কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ও মংলায় রয়েছে ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি। এর বাইরে গাজীপুরেও একটি পরচুলা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরণের চুল প্রস্তুত ও রপ্তানি করে। পিচ হিসেবে চুল রপ্তানি হয়।
ইপিজেডের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ বা বেপজা জানিয়েছে, ২০১০ সাল থেকে এসব প্রতিষ্ঠান এ দেশে উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করেছে।
বেপজার জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নাজমা বিন্তে আলমগীর প্রথম আলোকে জানান, ২০১০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত এভারগ্রিন প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরি গত জুলাই পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২০৮ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে রপ্তানি শুরু করা এমজেএল কোম্পানিটি গত জুলাই পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ তিন হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮৫ লাখ ২১ হাজার ডলারের পরচুলা, কৃত্রিম ভ্রু ও চোখের পাতার লোম রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ২০ কোটি টাকার রপ্তানি বেড়েছে।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে সরাসরি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ফ্যাশনেবল পরচুলার বিশাল এক বাজার গড়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আফ্রিকায় এই বাজারের বিস্তৃতি ক্রমেই বাড়ছে। আফ্রিকায় পরচুলার বাজারের বিস্তৃতির কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ওই সব দেশের ছেলেমেয়েদের চুলের গড়ন থাকে বেশ ছোট ছোট। তাই সেখানকার মেয়েরা এখন ওইসব চুলের পরিবর্তে বিভিন্ন রঙের পরচুলা ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছেন।
ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, পরচুলা, ভ্রু ও চোখের পাতার কৃত্রিম লোমের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজারটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকার একাধিক দেশ।
প্রাইস মেশিন নামের একটি ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, আমেরিকার বাজারে মানভেদে পরচুলার খুচরা মূল্য ১০ থেকে ৪৫৭ ডলার পর্যন্ত। তবে দেশ ও মানভেদে দামের আরও রকমফের রয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরের এ খাতের ৮৫ লাখ ২১ হাজার মার্কিন ডলারের রপ্তানির মধ্যে ৪৮ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর যুক্তরাজ্যে হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ ডলারের পণ্য।
২০১৩-১৪ অর্থবছরের এক কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ডলারের রপ্তানির মধ্যে প্রায় ৭৩ লাখ ডলারের পণ্য গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর যুক্তরাজ্যের বাজারে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ লাখ ডলারের।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও জানান, নিয়মিত ব্যবহারের বাইরে ফুটবল বিশ্বকাপের মতো বড় বড় আয়োজন যখন হয়, তখন এর চাহিদা আরও বেড়ে যায়। দর্শকেরা নানা সাজগোজ করে মাঠে উপস্থিত হন। সেসব সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে নানা রঙের পরচুলার ব্যবহারটিই বেশি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, কোরিয়া, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে এ ধরনের পণ্য তৈরি হয়, পরে যা আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। বাংলাদেশে পরচুলার কাঁচামাল হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহার হয় সিনথেটিকের। চীন, জাপান ও কোরিয়া থেকেই সর্বাধিক কাঁচামাল আমদানি করা হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।