এ যেন অসংসদীয় আর অশালীন ভাষা ব্যবহারের প্রতিযোগিতা। স্পিকারের সতর্কবাণী অথবা জনমানুষের সমালোচনা কোন কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে কটাক্ষ করার ক্ষেত্রে এরই মধ্যে রেকর্ড গড়েছে দশম সংসদ। চলতি সংসদে সবচেয়ে বেশিবার খুনি বলা হয়েছে তাকে। সংসদের মাত্র আট মাস মেয়াদেই আওয়ামী লীগ, জাসদ ও জাতীয় পার্টির এমপিরা ৪০ বার এ শব্দ উচ্চারণ করেন। অপরদিকে নবম জাতীয় সংসদে সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে খুনি বলা হয়েছে ৩৩ বার। এছাড়া অষ্টম সংসদে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমানকে খুনি বলা হয়েছে ২ বার। অপরদিকে বিগত তিন সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ফেরাউন’ বলা হয়েছে চারবার। ফেরাউন ও খুনি শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় ২০১০ সালের ৩রা মার্চ সংসদ অধিবেশনে। প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় এমপিরা এসব ভাষা ব্যবহার করেন। দলীয় এমপিদের চাপ ও প্রতিবাদ এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্পিকারদের স্ব-প্রণোদিত উদ্যোগে এসব অসংদীয় শব্দ সংসদের রেকর্ড থেকে বাদ (এক্সপাঞ্জ) দেয়া হয়েছে। তিন সংসদের দৈনিক কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী অশালীন বা আপত্তিকর শব্দ বা বাক্য ব্যবহার অনুচিত। তবে এ নিয়ে কোন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। তাই এটা মানা না মানা নির্ভর করে এমপিদের ওপর। আবার কোন শব্দ সংসদের রেকর্ড থেকে বাদ দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে স্পিকারের হাতে। নবম সংসদে এমপিদের অসংসদীয় ভাষা বা শব্দ ব্যবহার দেখে এক পর্যায়ে স্পিকার আবদুল হামিদ এডভোকেট রুলিং দেন। তিনি বলেন, কোন শব্দ বা ভাষা অসংসদীয় হলে তা অটোমেটিক রেকর্ড থেকে বাদ দেয়া হবে। রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায়, দুই সংসদে ৯৪৬টি শব্দ ও বাক্য এক্সপাঞ্জ করা হয়। এর মধ্যে ৮ম সংসদে ২৯৪টি, নবমে ৬৫২টি। অসংসদীয় ভাষা ও বাক্য ব্যবহার করায় কয়েক এমপির দেয়া বক্তব্যও রেকর্ড থেকে মুছে ফেলার নজির রয়েছে। ৮ম সংসদে জিয়াকে প্রথম খুনি বলা হয় ২০০৪ সালের ২০শে জুন। পরে ২০০৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো একই শব্দ ব্যবহার করা হয়। বিএনপি দলীয় এমপিদের প্রতিবাদে স্পিকার ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকার তা এক্সপাঞ্জ করেন। ওই সংসদের মেয়াদ ছিল ২০০১ সালের ২৮শে জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি পর্যন্ত। নবম সংসদে প্রথমবার খুনি উচ্চারণ করা হয় ২০০৯ সালের ২৩শে জুন। ওইদিন জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক ও খুনি বলে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি। নবম সংসদে ২০১০ সালের ৩রা মার্চ বিএনপি দলীয় এমপি শাম্মী আক্তার তার বক্তব্যে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরে জনগণ তো দূরে থাকুক আওয়ামী লীগ নেতারা পর্যন্ত ইন্নালিল্লাহ পড়েননি। আমরা জানি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান যখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তার আগেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তিনি শুধু নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, দেশবাসীকে করেছিলেন বিপন্ন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। আমরা জানি তার মৃত্যুর পরে তার জীবিত সন্তানেরা কোন আন্তর্জাতিক সংস্থায়, কোন মানবাধিকার সংস্থায় এমন কি কোন বিচার বিভাগীয় সংস্থায় ফরিয়াদ পর্যন্ত করেননি। আমরা এ-ও জানি ওই সময়ে লন্ডন প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- শোকর আলহামদুলিল্লাহ, দেশ আজ ফেরাউনের হাত থেকে মুক্ত হলো। একই দিন আরও তিনবার বঙ্গবন্ধুকে ফেরাউন বলা হয়। এদিকে জিয়াউর রহমানকে খুনি বলায় ওয়াকআউটের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। ২০১৩ সালের ১৩ই জুন জিয়াউর রহমানকে কর্নেল তাহেরের খুনি বলায় সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন বিরোধী দলের এমপিরা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জন্য ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট নির্মাণ সংক্রান্ত বিলের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে ওই মন্তব্য করেন। এ সময় বিরোধী দলের এমপিরা তুমুল হৈ চৈ করেন। টেবিল চাপড়ে প্রতিবাদ জানান। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর জিয়াউর রহমান ২৫০০ সেনা সদস্য হত্যার জন্য দায়ী। এমনকি কর্নেল তাহের হত্যার জন্য তাকে দায়ী করে আদালত ইতিমধ্যে রায় দিয়েছে। তার এ বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই বিরোধী দলের সদস্যরা আসন ছেড়ে চলে যান। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে তারা হৈচৈ করে ওঠেন। এরপর চলতি দশম সংসদে জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার খুনি বলা হয়। ১০ই এপ্রিল সংসদের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ খুন করাই বিএনপির রাজনীতি। তাদের হাত থেকে মসজিদ, মন্দির গির্জা কোন কিছুই রেহাই পায়নি। আর লোকে বলে জিয়াউর রহমান নাশতার টেবিলে বসে মৃত্যুদণ্ডে সই করতেন। এতে উনার কোন সমস্যা হতো না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খোন্দকার মোশ্‌তাক বেইমান খুনি, সে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিল। জিয়াউর রহমানকে খুনি মোশ্‌তাক সেনাপ্রধান বানিয়েছিল। আর জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। জিয়া, মোশ্‌তাক সবাই খুনি ছিলেন। ৩১শে মার্চ জিয়াউর রহমানকে শহীদ বলা উচিত নয় দাবি করে জাতীয় পার্টির নাসিম ওসমান বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনি। খুনি বলেই তাকে খুন হতে হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হয়েছিলেন। জাতিকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে হত্যা করা হয়।