কারাগার রাজনীতিবিদদের নতুন কোন ঠিকানা নয়। উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য এ যেন দ্বিতীয় বাড়ি। যদিও কারাভোগের ধরন, সময় আর শাসন ভেদে ছিল আলাদা। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতিবিদদের জন্য দেখা মিলেছে এক তৃতীয় বাড়ির। নিজ বাড়ির বাইরে প্রায় প্রতি সপ্তায়ই তারা হাজিরা দিচ্ছেন সেখানে। কোন কোন নেতাকে
দিতে হচ্ছে প্রতিদিনই। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে যে হারে মামলা রয়েছে তাতে আগামী ৪৪ কার্যদিবসের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ দিনই হাজিরা দিতে হবে। এর মধ্যে সিনিয়র ৮ নেতাকে হাজিরা দিতে হবে প্রতিদিনই। মামলায় হাজিরা দেয়ার কারণে বাতিল হয়ে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি। স্থবিরতা দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক কাজকর্মেও। এছাড়া প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলায় সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে চার্জগঠন। সরকারের এই কৌশলে দিশাহার হয়ে পড়েছে বিএনপি। সরকার পতনের ডাক দিয়ে রাজপথে পালন করছে আলোচনা-সভা আর মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচি। ২৪শে আগস্ট রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সংগঠনটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী হাজির হয়েছিলেন অনুষ্ঠানস্থলে। কিন্তু সিনিয়র নেতাদের আদালতে মামলার হাজিরার কারণে শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয় অনুষ্ঠান। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে পাঁচটি। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৫টি। ৪৭টি মামলায় হয়েছে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে। সোমবার তার বিরুদ্ধে মানহানির আরও এক মামলা দায়ের করেন এক আওয়ামী লীগ নেতা। এর মধ্যে ২১টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে। ১৯টি মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের কার মামলায় দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে কারাভোগ করছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে রয়েছে ২০টি মামলা। ওয়ান-ইলেভেনের অবৈধ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৪টি মামলা দেয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের করা হয়েছে বাড়ি দখলসহ জ্বালাও-পোড়াওয়ের অভিযোগে নতুন ১৬টি মামলা। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ’র বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজি ও পুলিশ হত্যাসহ ১১টি মামলা। স্থায়ী কমিটির এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে ৯টি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ২৩টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪১টি, গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে রয়েছে এক ডজন মামলা। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান এ নেতা বর্তমানে কনডেম সেলে রয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মেজর (অব.) এম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, ফজলুর রহমান পটল, আবদুস সালাম পিন্টু, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, খোন্দকার মাহবুব হোসেন, শওকত মাহমুদ, ডা. জাহিদ হোসেন, সাংগঠনিক ফজলুল হক মিলন, মজিবর রহমান সরোয়ার, মশিউর রহমান, গোলাম আকবর খোন্দকার, হারুনুর রশীদ, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, নাজিমউদ্দিন আলম, জাকারিয়া তাহের সুমন, স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিশেষ সম্পাদক নাদিম মোস্তফা, অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন চৌধুরী পিন্টু, আসলাম চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের শতাধিক নেতা ৫ থেকে ৩০টির বেশি মামলার আসামি। বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম বলেন, প্রতি সপ্তাহে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আদালতে হাজিরা দেয়ার কারণে সাংগঠনিক কাজ-কর্মও ঠিকমতো করতে পারছি না। তবে মামলা দিয়ে আমাদের দমাতে পারবে না। এদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ৫৭টি, সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৩০টি, রিজভী আহমেদের বিরুদ্ধে ১২টি, বরকত উল্লাহ বুলু, মিজানুর রহমান মিনু ও মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে একাধিক, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে ৪টি, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এহসানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ৩৭টি, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২২টি, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর বিরুদ্ধে ১৯টি, সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ১৬০টি মামলা রয়েছে। বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার আমার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দিয়েছে। সপ্তাহের প্রায় দিনই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। সরকার জনসমর্থনহীন হয়ে এখন মামলা দিয়ে বিরোধী নেতাদের ঘায়েল করতে চাচ্ছে। তবে গণআন্দোলনেই এই সরকারের পতন নিশ্চিত হবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের ব্যক্তিগত সহকারী মো. স্বপন জানান, সপ্তাহে দু-একদিন ছাড়া বাকি সব দিনই আদালতে হাজিরা দেন আমানউল্লাহ আমান। তার বিরুদ্ধে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৫৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে ৭টি মামলায় চার্জগঠন করা হয়েছে। আজও একটি মামলায় চার্জগঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। ওদিকে যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ১১০টি, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবের বিরুদ্ধে ১৩০টি, সাংগঠনিক সম্পাদক আকম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে রয়েছে ২২টি, মহানগর উত্তরের সভাপতি মামুন হাসানের বিরুদ্ধে ১৩৯টি, সাধারণ সম্পাদক এসএম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ১১৬টি, মহানগর দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল আলম মজনুর বিরুদ্ধে ১১০ এবং সাধারণ সম্পাদক হামিদের বিরুদ্ধে রয়েছে ৫২টি মামলা।
যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, মাসের এমন কোন সপ্তাহ নেই যে মামলার হাজিরা দিতে হয় না। কোন কোন সপ্তাহের পাঁচদিন মামলার হাজিরা দিতে হয়। মহানগর দায়রা জজ ও সিএমএমসহ সব আদালতেই আমার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সরকার মামলা আন্দোলন দমন করতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু মানুষের গণআন্দোলনের মুখে তাকে মুক্তি দিয়ে বাধ্য হয়েছিল। বর্তমান সরকারও একই কৌশল অবলম্বন করছে। আমরা আইনিভাবে ও আন্দোলনের মাধ্যমে সব কিছু মোকাবিলা করবো।
ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ৭০টি, সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপুর বিরুদ্ধে ৭০টি, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবুর বিরুদ্ধে ৫৫টি, মহানগর উত্তরের সভাপতি ইয়াসিন আলীর বিরুদ্ধে ৫০টি ও দক্ষিণের সভাপতি আলী রেজাউর রহমান রিপনের বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা রয়েছে। ছাত্রদল নেতাদের মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসহাক সরকার। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ১৭০টি মামলা। এছাড়া সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে ৮০টি, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিবের বিরুদ্ধে ১৪০টি ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসিরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৬০-এর বেশি মামলা। এছাড়া, সিনিয়র সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের বিরুদ্ধে ১৫টি, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি আবুল মনসুর খান দীপকের বিরুদ্ধে ১৮টি, উত্তরের সম্পাদক হুমায়ুন কবির রওশনের বিরুদ্ধে শতাধিক, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে ৮টিসহ কেন্দ্রীয়, ঢাকা মহানগর ও জেলা কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। সংশ্লিষ্ট নেতাদের আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, কোরবানি ঈদের আগে মওদুদ আহমদকে ১১ দিন, হান্নান শাহকে ৪ দিন, এমকে আনোয়ারকে ৫ দিন, গয়েশ্বর রায়কে ৯ দিন, সাদেক হোসেন খোকাকে ১০ দিন, আমানউল্লাহ আমানকে ১৩ দিন, রিজভীকে ১১ দিন, সালাহউদ্দিন আহমেদকে ৮ দিন, জয়নুল আবদিন ফারুককে ৮ দিন, আলালকে ১২ দিন আদালতে হাজির হতে হবে। এছাড়া যুবদল নেতা নীরব, স্বেচ্ছাসেবক নেতা সোহেল, সপু, বাবু, ছাত্রদল নেতা জুয়েল, হাবিবসহ ৮ নেতাকে আগামী ৪৪ কার্যদিবসের মধ্যে ৪০ দিনই আদালতে হাজির হওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।