কক্সবাজারে ব্যবসায়ী ফারুক হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেছেন সরকার সমর্থক তিন সংগঠন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জাসদ। গতকাল কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে ব্যবসায়ী ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট এ কে আহম্মদ হোসেন, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এডভোকেট মোহাম্মদ তারেক, জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবুল কালাম আযাদ এ দাবি করেন। একই দাবিতে সংবাদ সম্মেলন থেকে তিন দিনের আলটিমেটাম দেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের আইনের আওতায় আনা না হলে সোমবার থেকে অর্ধদিবস ধর্মঘট পালন করবে সৈকত পাড়ের ব্যবসায়ীরা। একই সময়ে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হবে। ওই সময় প্রত্যেক ব্যবসায়ী কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। এতেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা না হলে পরবর্তী বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হবে। সম্মেলনে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল আবছার। কক্সবাজার দোকান মালিক ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তাক আহম্মেদ, সদর উপজেলার সাবেক (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির নেত্রী নাছিমা আকতার বকুল, যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী আয়েশা সিরাজসহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নিহত ব্যবসায়ী ওমর ফারুকের পিতা আলী হোসেন বলেন, কক্সবাজার সৈকত এলাকার ঝিনুক ব্যবসায়ী ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় চলতি বছরের ১০ই জুলাই রাতে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শহর ফাঁড়ির পুলিশের টিএসআই, এটিএসআইসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও তাদের কথিত সোর্সরা জড়িত বলে প্রত্যক্ষদর্শীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। জড়িতদের গ্রেপ্তারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্টমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বরাবরে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। একই দাবিতে শহরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী। কিন্তু অদ্যাবধি দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো তাদের রক্ষার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ৩ মাস আগে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো ও ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার অভিযোগে ব্যবসায়ী ওমর ফারুকের ভাই মোহাম্মদ রুবেলকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে শহর ফাঁড়ির পুলিশের টিএসআই মতিউর, এটিএসআই দেলোয়ার, মজিবরসহ আরও দুজন পুলিশ সদস্য। ওই রাতে আটক গাড়িসহ তাকে মুক্ত করতে ১ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে মোটরসাইকেল রেখে দিয়ে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান রুবেল। রুবেল মুক্ত হওয়ার ৩ দিন পর শৈবাল হোটেলের সামনে আরও ৩০ হাজার টাকা দিয়ে থানা থেকে মোটরসাইকেল নেন তিনি। রুবেলের হয়ে টিএসআই মতিউরের হাতে টাকা তুলে দেন ওমর ফারুক। ওই সময় এটিএসআই দেলোয়ার, মজিবর, আকতার, আনোয়ার, সোর্স খোরশেদ ও জসিমও উপস্থিত ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে আরও ২০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলে পুলিশ। অন্যথায় কপালে দুঃখ আছে বলে শাসিয়ে যায়। ১০ রমজান ঘটনার দিন রাতে শহর ফাঁড়ি পুলিশের একটি টিম তাদের বহনকারী মাহিন্দ্র সিএনজি যোগে উর্মি রেস্টুরেন্টের বিপরীতে মক্কা হোটেলের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। ওখানে একটি দোকানে বসে ব্যবসায়ীরা তাস খেলে সময় পার করছিলেন। ওই দোকানে গিয়ে পুলিশের সিভিল টিমের সদস্যরা ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চান ফারুক কে? খেলারত ব্যবসায়ীরা খেলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যান এবং এখানে ফারুক নেই, ওই দিকে থাকতে পারে বলে জানান। সামান্য দূরে লাইটের আলোতে মারবেল খেলা করছিলেন ব্যবসায়ীদের আরও একটি গ্রুপ। ওইখানে ফারুককে দেখে চিনেন আগে টাকা নেওয়া পুলিশ সদস্য ও সোর্সরা। তারা এগিয়ে গিয়ে ফারুককে ঝাপটে ধরেন। ওই সময় ব্যবসায়ী ফারুক পুলিশ ও কথিত সোর্সকে ধাক্কা দিয়ে জেলা পরিষদের খোলা মঞ্চের সামনের পথ দিয়ে শৈবাল এলাকার দিকে দৌড় দেন। সোর্স এবং পুলিশও তার পিছু নেয়। তবে যে পথে পুলিশ ও সোর্স তাকে ধাওয়া করে এগিয়ে যায় ওই পথ দিয়ে তারা ফিরে আসেনি। তারা শৈবাল হোটেলের পথ দিয়ে রাস্তায় ওঠে। পরদিন সকালে শৈবাল পয়েন্টে ব্যবসায়ী ফারুকের লাশ দেখতে পায় এলাকাবাসী। এ ঘটনায় থানায় এজাহার দেয়ার আগেই সন্দেহভাজন ৩জনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে সদর থানা পুলিশ। সকালে শৈবাল পয়েন্টে লাশ দেখতে গিয়ে আটক হন মোহাম্মদ টিটু। ফারুকের লাশ দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না ব্যবসায়ী ফারুকের মৃত্যু। তাই ক্ষোভ থেকে পুলিশের সামনেই চিৎকার করে বলছিলেন রাতে পুলিশ ও সোর্সরা মিলে ফারুককে ধাওয়া করার ঘটনা। তিনি এ-ও বলেন, পুলিশ ও সোর্সরা তাকে পিঠিয়ে মেরে ফেলেছে। এরপরও তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় সন্দেহভাজন আরও দুজনকে। আটককৃতরা থানায় ওসির কাছে ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। জানান, পুলিশ ও সোর্সদের ঘটনাস্থলে যাওয়া থেকে লাশ পাওয়া পর্যন্ত ঘটনা। কিন্তু ওসি রহস্যজনক কারণে তাদের কথা আমলে নেননি। উল্টো তাদের হত্যা মামলায় (নং ৩৮) সন্দেহভাজন আসামি দেখিয়ে চালান করা হয়।
ঘটনার প্রত্যেক্ষদর্শী রেজাউল করিম রেজু জানান, পুলিশের সিভিল টিমের সদস্যরা ফারুক মনে করে প্রথমে তাকে ঝাপটে ধরে। পরে তিনি ফারুক নন নিশ্চিত হয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। তিনি বলেন, তাকে ছেড়ে দিয়ে শহর ফাঁড়ির পুলিশ ও সিভিল সদস্যরা পাশে খেলারত ফারুকদের দিকে এগিয়ে যায় এবং তাকে ধাওয়া করে। পরের ঘটনা সবার জানা।
রেজাউল করিম রেজুর মতোই ছাতা বিচ মার্কেটের পাহারাদার আবু তাহের, বিচকর্মী রশিদ, ব্যবসায়ী আলী, ইদ্রিস, সাইফুল, মহিবুল্লাহ, বশির, মানিকসহ শ’ শ’ ব্যবসায়ী ওই রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এতে প্রতীয়মান হয় যে, পুলিশ ও সোর্সরা মিলে ব্যবসায়ী ওমর ফারুককে পিটিয়ে মেরেছে। অথচ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা এখনও বহাল-তবিয়তে রয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা খুবই অসহায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে আমাদের পরিবারে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। অনাহারে অর্ধহারে আমাদের দিন কাটছে। আমাদের বিশ্বাস, আপনারা চাইলে এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব। আপনারা আপনাদের লিখনীর মাধ্যমে প্রকৃত সত্য ঘটনা তুলে ধরবেন এবং অপরাধীদের শাস্তি যেন নিশ্চিত হয় তার জন্য যথাযথ ভূমিকা রাখবেন- এ প্রত্যাশা করছি।