গত শুক্রবারের একটি দৈনিকের প্রথম পাতার একটি খবরের শিরোনাম: ‘সাভারে পাঁচ ভুয়া ডিবি পুলিশ আটক’। শেষ পাতায় আরেক খবরে বলা হয়, র্যাবের মোবাইল কোর্ট সাভারেই ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের চেম্বারে অভিযান চালিয়ে ১০ জন ভুয়া ‘দন্ত চিকিৎসককে’ দণ্ড দিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো ডিগ্রি তো নেই-ই, এসএসসি পর্যন্ত পাস করতে পারেননি। …তাঁদের নামের শেষে আবার বিভিন্ন ইংরেজি শব্দে লেখা নানা ‘ডিগ্রি’। বছরের পর বছর ধরে তাঁরা করছেন ‘দন্ত চিকিৎসা’। তাঁদের চেম্বারের দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন সনদ। বাংলার মাটিতে মানুষটির চেয়ে একটি সনদের দাম বেশি। সে জন্য সনদ জোগাড়ের হিড়িক পড়েছে।
একই সময় পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের সংবাদও কাগজে এসেছে। অন্যান্য পেশার ভুয়ার সঙ্গে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার পার্থক্যটা এখানে যে, অন্যান্য ভুয়া ধরা পড়লে তাদের কোমরে দড়ি পড়ে, হাতে হাতকড়া এবং ঢুকতে হয় গিয়ে শ্রীঘরে; কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সে ভয় নেই। কারণ, এ মাটিতে আসল ভালো নকল ভালো। শুধু এই পাঁচ সচিব নন, ‘এর আগে ১৮২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের সনদ বাতিল করা হয়।’ তবে ভুয়া ডিবি, ভুয়া পুলিশ অফিসার, ভুয়া র্যাব, ভুয়া দন্ত চিকিৎসক, ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া চাকরিদাতা, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতির মতো কেউ হাজতে যাননি।
সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মুক্তিযোদ্ধার সনদপ্রাপ্তির আগে যে প্রস্তুতিপর্ব গেছে, সেটি ছিল খুবই নাটকীয়। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা শোনার পর তাঁরা আর স্থির থাকতে পারেননি। হঠাৎ এক রাতে ধর্মপত্নীকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বললেন: গত ২৬ বছর তোমাকে একটা কথা কই নাই।
কী সে কথা? উৎকণ্ঠার সঙ্গে স্ত্রী মনে মনে বলেন, অতীত জীবনের প্রেম-ট্রেমের কথা নাকি! বিয়ের আগে কোনো সহপাঠী বা মামাতো-খালাতো কারও সঙ্গে কিছু হয়েছিল কি না, সে সন্দেহও জাগে।
সহধর্মিণীর চোখেমুখে উদ্বেগ লক্ষ করে কর্তা বলেন, ডরাইও না। কোনো খারাপ কথা না।
সন্ধ্যায় সুপার মার্কেটে গিয়ে প্রচুর কেনাকাটা করে বেগম সাহেবা ক্লান্ত। আজকাল প্রায়ই মাথা ধরে। সিঙ্গাপুরে চেকআপে যাওয়া দরকার। বলেন, কী কথা, তাড়াতাড়ি কও। আমি ঘুমাব।
বাতি নিভিয়ে ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে কর্তা অমোঘ স্বীকারোক্তির মতো বলেন, আসলে আমি একজন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। বিবর্ণ আলোয় তিনি কথাটি বললেন বটে, কিন্তু হঠাৎ তাঁর বুকটা কেঁপে ওঠে।
বেগম সাহেবা বলেন, কও কী? তুমি না বলছিলা ওই বছরই তোমার খুব ধুমধাম কইরা খাতনা হয়?
কর্তা বলেন, তাতে কী? কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাইতেছি।
একদিন সনদ নিয়ে বাড়ি ফেরেন কর্তা। তাঁর মনোবল একজন মুক্তিযোদ্ধার মতোই বেড়ে যায়। একটা বীর বীর ভাব! গিন্নিকে বলেন, ড্রয়িং রুমের শোকেস তো হাবিজাবি ক্রেস্ট-ট্রেস্ট দিয়া ভইরা ফেলাইছ। এই সার্টিফিকেট বাঁধাই কইরা রাখবা। কেউ ঘরে ঢুকলেই যাতে চোখে পড়ে। সনদের ৫০টি ফটোকপি করা আছে।
কয়েক দিন পর কানাডাপ্রবাসী এক শালা আসেন। তিনি দেয়ালে তাকিয়ে বলেন, দুলাভাই, মুক্তিযোদ্ধার এই সার্টিফিকেট পাইলেন কই?
বোকার মতো কথা কইও না মিয়া—তিনি কথা শেষ না করতেই শ্যালকের মেজো আপা বলেন, তোর দুলাভাই তো বীর মুক্তিযোদ্ধা। শোনোস নাই?
রাতে খাওয়ার সময় শ্যালক আবার ওই প্রসঙ্গ পাড়েন। বলেন, আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেন?
কর্তা বলেন, তোমার ওই সেক্টর-টেক্টরের কথা ছাইড়া দেও। আমাদের গ্রামে নদীর পাড়ে শ্মশানঘাটে পাকসেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। আমরাই করি। রাইফেল নিয়া ক্রলিং করতে করতে আধা কিলোমিটার যাই। বুকটুক সব ছিলা গেছিল। বলতে বলতে শ্যালকের প্লেটে বড় পাবদা মাছটা তুলে দেন।
আবার বলেন, তবে কথা কি জানো তুতুল মিয়া, পাকসেনাদের ভয় করি নাই। ডরাই এখন পত্রপত্রিকারে। স্লারা কিছুই ছিঁড়তে পারব না, কিন্তু ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে ডায়াবেটিস-ব্লাডপ্রেশার কোলেস্টেরলের