পবিত্র হজ্ব সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় বিতর্কে জড়িয়ে সম্প্রতি মন্ত্রিসভা থেকে অব্যহতি পাওয়া সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী অবস্থান করছেন কলকাতায়। অপেক্ষা করছেন দেশে ফেরার সবুজ সংকেতের। অপরদিকে তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছে দল এবং সরকার। তার কোনো ব্যাখ্যাই আমলে নিতে প্রস্তুত নয় আওয়ামী লীগ। উপরন্তু দল থেকে তাকে বহিষ্কারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে খুব সম্প্রতি।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইর্য়ক সফরকালে গত ২৮ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি কিন্তু হজ্ব আর তাবলীগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। তবে তার চেয়েও হজ্ব ও তাবলীগ জামাতের বেশি বিরোধী। এ হজ্বে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। হজ্বের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনও কাম নাই। এদের কোনও প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে।
এর পরপরই জাতীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয় তুমুল বিতর্ক। এরই প্রেক্ষিতে সরকার একটা পর্যায়ে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যহতি দেয়। ওদিকে দেশে ফিরতে উদগ্রীব সাবেক এই মন্ত্রী সবুজ সংকেতের আশায় এসে হাজির হন কলকতা। তারপর থেকেই তিনি সেখানে অবস্থান করছেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার বরাত দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, লতিফ সিদ্দিকী প্রতিবেশী দেশ ভারত ছেড়ে অন্য কোনো দেশে গেলে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা খুশি হবেন। তবে তাঁর সঙ্গে দল কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত কোনো যোগাযোগ করা হবে না। তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাতেও সাড়া দেওয়া হবে না। বরং এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা হবে, যাতে তিনি নিজে থেকেই দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতার বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, লতিফ সিদ্দিকী দেশে আসার অর্থই হচ্ছে ধর্মভিত্তিক দল, সংগঠন ও সরকারবিরোধীদের হাতে ইস্যু তুলে দেওয়া। সরকার ও আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে এ ঝুঁকি নেবে না। ২৪ অক্টোবর দলের কার্যনির্বাহী সংসদের পরবর্তী বৈঠকে তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে প্রথম আলো জানায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আরব দেশগুলোর মনোভাব নিয়ে সরকার সব সময় কিছুটা অস্বস্তিতে থাকে। হজ যেহেতু সৌদি আরবের একটা বড় উৎসব, তাই লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যে সৌদি সরকার যাতে আহত না হয়, সে বিষয়ে সরকার কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল। তাই ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে দৈনিক নয়া দিগন্তের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যের কোনো ব্যাখ্যাই আপাতত আমলে নেবে না দলটি। ধর্মপ্রাণ মুসলিম, বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন এবং সরকারবিরোধীদের সামাল দেয়ার লক্ষ্যে তার সাথে সব ধরনের সম্পর্কই ছিন্ন করার পক্ষে দলের নীতিনির্ধারকেরা। লতিফ ইস্যুর দ্রুত অবসানও চায় আওয়ামী লীগ। সে জন্য আগামী ২৪ অক্টোবর দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেই তাকে দল থেকে বহিষ্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।
স্রেফ গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার কারণে লতিফ সিদ্দিকীকে কারণ দর্শানর নোটিশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সূত্রগুলোর বরাতে পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, যাতে পরবর্তীতে এ নিয়ে দলকে কোনো আইনি ঝুটঝামেলায় না পড়তে হয় সেজন্যই এই নোটিশ। যে ব্যাখ্যাই সাবেক এই মন্ত্রী দেন না কেন, তা গ্রহণ করা হবে না। এ ব্যাপারে ১২ অক্টোবরই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, পরের কাজগুলো আনুষ্ঠানিকতামাত্র।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ওই অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী আরো বলেন, তাবলীগ জামাত প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদের তো কোনও কাজ নেই। সারা দেশের গাড়িঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।
তিনি তার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়েও বিরূপ মন্তব্য করেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে বলেন, কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন। ‘জয় ভাই’ কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন।
প্রবাসীদের সম্পর্কে এসময় তিনি মন্তব্য করেন, বিদেশে এসেছেন কামলা দিতে। রাজনীতি করার দরকার কী?
মঞ্চে বসা টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধা ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. নুরুন্নবীকে উদ্দেশ করে মন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের জন্য একবার তাঁর (নুরুন্নবী) কাছে চাঁদা চেয়েছিলাম। তিনি ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এক লাখের কম কারও কাছ থেকে চাঁদা নেয় না।
এবক্তব্যের পরপরই দেশে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলায়ও হয় বেশ কয়েকটি। গত ১ অক্টোবর প্রথম তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে ঢাকার আদালত। ধর্ম অবমাননার কারণে দায়ের করা দু’টি মামলায় আগামী ২৮ ও ৩০ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির হয়ে তার বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে সমন জারি করেন আদালত। ঢাকা মেট্রোপলিটন আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এএনএম আবেদ রেজা এবং আলহাজ্ব মো. বাদল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানের আদালতে প্রথম মামলাটি দায়ের করেন। দ্বিতীয় মামলাটি পূর্ব ইসলামবাগের চামড়া ব্যবসায়ী মো. বাদল মিয়া দায়ের করেন।
এরপর আজ সোমবারও একই ধরণের অপর এক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকা মহানগর আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহের নিগার এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিাযোগে লায়ন মো: আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে গত ২ অক্টোবর সিএমএম আাদালতে মামলাটি করেছিলেন। ওই দিন আদালত আসামিকে হাজির হওয়ার জন্য সময় বেধে দিয়ে সমন জারি করেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় আজ লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন।