জিসান আহমেদ, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: প্রত্যূষে পূর্ব গগনে জ্বলে উঠছে অগ্নিস্বম সূর্য। বাতাসে কোমলতার মৃদু আভাস। কোকিলের কুহু কুহু আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারিপাশ। এমন স্বর্গরুপ পৃথিবীর উদ্ভাসিত আলোর মাঝে প্রতিদিন ঘুম ভাঙতো বাংলার কোটি কোটি মানুষের। যা আজ কেবলই বইয়ের মোড়কে বন্দিথাকা প্রত্যাশিত ইতিহাস।
আজ গ্রাম বাংলার মানুষ হয়তোবা সকালে জেগে ওঠে হারিয়ে যেতে বসা কিছু দূস্প্রাপ্য পাখির কলরব শুনে। আর শহর অঞ্চলের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে কাকের কর্কশ শব্দ শুনে কা কা। কোকিলের ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গার স্বপ্ন যেন অরন্যের রোদন।
প্রকৃতির প্রতি মানুষের অযাচিত ব্যাবহারের কারনে প্রকৃতি যেন আজ মানুষের প্রতি ক্ষুব্ধ। প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের সকল উপহারগুলো পরিবেশ থেকে ক্রমেই গুটিয়ে ক্ষনে ক্ষনে।
যান্ত্রিক এই নগরায়নের যুগে প্রকৃতির প্রতি খেয়াল রাখার ইচ্ছা মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে ইকোসিষ্টেম। আমরা পৃথিবীর মানুষেরা এগিয়ে যাচ্ছি ভয়ানক এক ভবিষ্যতের দিকে।
সমগ্র পৃথিবী যখন নগরায়নের দিকে ছুটছে ঠিক সেই সময় ¯্রােতের উল্টোদিকে হাটতে শুরু করেছে চুয়াডাঙ্গার জেলা সদরের বেলগাছি গ্রামের মানুষ।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল থেকে ৩ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করলে রাস্তার দুই পাশের গাছগুলোতে চোখে পরবে হাজারো মাটির কলস। কিছু কিছু গাছে রয়েছে মাটির কলস এবং ঝুড়ি। আবার রাস্তার পাশে চোখে পড়বে “পাখি শিকার নিষেধ” “পাখির বন্ধু” “পাখির গ্রাম” “আসুন পাখি হত্যা থেকে বিরত থাকি” এ রকম কিছু সাইনবোর্ড।
মাটির কলস ও ঝুড়ি গুলোতে বাস করছে দোয়েল, কোয়েল, ময়না শ্যামা, শালিক, প্যাচা ও ঘুঘুর মত কিছু পাখি। শুধু পাখিই নয় এসকল কলস ও ঝুড়িগুলোকে আসাবস্থল হিসেবে ব্যাবহার করছে কাঠবিড়ালি, সাপ, গুইসাপ, গিরগিটিসহ নানা প্রজাতির বিভিন্ন প্রানি।
ব্যাতিক্রম ধর্মী এ উদ্দোগের পিছনে যারা বিনা-পারিশ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা হলেন “বেলগাছি যুব সমাজ” নামের একটি যুব সংগঠন।
সিমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ার চুয়াডাঙ্গা ও পাশ্ববর্তী জেলাতে যখন মাদক ছোবলের জয় জয়কার তখন ভবিষ্যৎ পরিবেশকে বাচানোর উপায় নিয়ে ভাবিয়ে তোলে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বেলগাছি গ্রামের স্কুল শিক্ষক বখতিয়ার হামিদ বিপুলকে। বখতিয়ার হামিদ বিপুল নিজ উদ্দোগে পরিবেশকে বাচানোর তাগিতে বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করেন। তার কাজ দেখে অনুপ্রানিত হয়ে আরো তিন চার জন যুবক তার সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শুরু করে। দেখতে দেখতে তাদের সংখ্যা দাড়ায় পয়ত্রিশে। এই ৩৫ জন সদস্য মিলে একটি সংগঠনের সৃষ্টি করেন যার নাম দেওয়া হয় “বেলগাছি যুব সমাজ”।
বেলগাছি যুব সমাজের পরিবেশ রক্ষা ভিত্তিক নানামুখি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, নিজ এলাকা বেলগাছিকে পাখির বসবাসের নিরাপদ অভয়ারন্য তৈরি করা, পাখি শিকার বন্ধে মানুষের আত্বিক বিবেককে জ্রাগত করা, পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনিয়তা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জানানো, চাষাবাদে কিটনাশক ব্যাবহার থেকে বিরত থাকা, এলাকার বয়স্ক স্বাক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদেরকে নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষিত করে তোলা।
পাখিদের বসবাস নিশ্চিত করার লক্ষে “বেলগাছি যুব সমাজ” নিজ গ্রাম বেলগাছির সমস্ত রাস্তার দুই পাশের সকল গাছে মাটির কলস ও ভার টাঙিয়ে দিয়েছে। যার ফলে ঐ সমস্ত কলস ও ঝুড়িতে বাস করছে হাজারো রকমের পাখিসহ নানা জাতের প্রানি।
নৈশ বিদ্যালয়ে চলছে নিয়মিত সান্ধকালিন পাঠদান, চুয়াডাঙ্গাসহ প¦ার্শবর্তী জেলার প্রায় দুইশত বিদ্যালয়ে “বেলগাছি যুব সমাজের” উদ্দোগে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনিয় কর্তব্য জানাতে নেয়া হয় বিশেষ ক্লাস। এলাকার কৃষকদেরকে কিটনাশক ব্যাবহারের কুফল জানাতে ব্যাক্তিগত ভাবে নিচ্ছে নানামুখি প্রচার অভিযান।
বেলগাছি গ্রামের কৃষক কামাল উদ্দিন জানান, “বেলপাছি যুব সমাজের” যুবকেরা আমাদেরকে কৃষিকাজে কিটনাশক ব্যাবহার থেকে বিরত থাকতে বলেছিল। ওরা আমাকে মাচিং পদ্ধতিতে জমি চাষ করতে বলায় আমি জমির বিভিন্ন জায়গায় কিছু খুটি পুতে দিয়েছিলাম। পাখিগুলো খুটিতে বসে থাকতো আর জমিতে থাকা সকল পোকামাকড়গুলোকে খেয়ে ফেলত। আর পাখির ত্যাগকৃত বিষ্ঠা জমিতে জৈব সাররুপে কাজ করত। ফলে জমিতে সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয়নি। ফলনও আশানুরুপ।
বেলগাছি যুব সমাজের এ উদ্দোগ দেখে অনুপ্রানিত হয়েছে এলাকার অন্য ব্যাক্তিরাও। গ্রামের চপ পেয়াজু বিক্রেতা আলফা উদ্দিন প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে তার অবিক্রিত চপ ও পিয়াজুগুলো খেতে দেন কলস ও ঝুড়িতে বসবাসরত পাখিদেরকে। ফলে খাবার সন্ধান পেয়ে ছুটে আসে হাজারো পাখি। আর কিচিরমিচির শব্দে বিমোহিত হন এলাকার মানুষগন।
“বেলগাছি যুব সমাজ” সংঘের প্রধান উদ্দোক্তা বখতিয়ার হামিদ বিপুল জানান, পরিবেশ সুরক্ষায় তিনি এবং তার সংঘের সদস্যরা ২০০৯ সাল থেকে কাজ করে আসছি। বন্য প্রানি এবং পাখি যদি না থাকে তাহলে ইকোসিষ্টেমের যে পরিবর্তন আসবে তা আমাদের পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার প্রয়োজনে হলেও আমাদেরকে পাখি ও বন্য প্রানিদের রক্ষা করা জরুরী। সেই প্রয়োজনিয়তার কথা চিন্তা করে আমরা কিছু যুবক এই উদ্দোগ নিয়েছি।
বেলগাছি গ্রামের জনপ্রতিনিধি পৌর কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার উদাসীন হলেও স্থানীয় যুবকেরা যে উদ্দোগ নিয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। তবে এ ব্যাপারে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সরকারের দায়িত্বশীল লোকেরা এগিয়ে আসলে এ ধরনের উদ্দোগ সফল করা অনেক সহজ হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রানি সম্পদ কর্মকর্তা ডঃ কোহিনুর ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গার বেলগাছি অঞ্চলের কিছু যুবক বিলুপ্তপ্রায় পুশুপাখি সংরক্ষনের ও অভয়াশ্রম তৈরিতে যে মহতি উদ্দোগ নিয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। এই উদ্দোগের ফলে এলাকার যে সকল পশুপাখিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে তা আবারো দেখা যাবে। সাথে সাথে রক্ষা হবে পাকৃতিক ভারসাম্য। এ উদ্দোগ সামগ্রিকভাবে সফল করতে সার্বিক সহযোগিরতার আম্বাসও দেন তিনি।
বেলগাছি যুব সমাজের এ উদ্দোগের কথা শুনে বসে থাকতে পারেননি চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশানসক দেলোয়ার হোসাইন। গত বুধবার(২২-১০-১৪) তারিখ বিকাল ৫টায় তিনি নিজে এসে বেলগাছি যুবকদের এ ব্যাতিক্রম ধর্মী উদ্দোগ দেখে যান।
চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশানসক দেলোয়ার হোসাইন জানান, যুবকেরা যে উদ্দোগ নিয়েছে তা খুবই ভালো একটি উদ্দোগ। এর ফলে এ এলাকার পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। পাখিরা অবাধে বিচরন করতে পারবে। এ উদ্দোগ সমগ্র জেলাতে নেওয়া হলে বাংলাদেশ চুয়াডাঙ্গাকে নতুন করে চিনবে। এব্যাপারে সরকারি নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে। যুবকেরা এ ব্যাপারে আরো উদ্দোগ নিলে তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
বেলগাছি গ্রামের সকল মানুষের ঘুমভাঙ্গে পাখির কিচিরমিচির শব্দে। যান্ত্রিক এ নগরায়নের পৃথিবীতে সংগ্রাম করার জন্য বেলগাছির প্রত্যেকটি মানুষ প্রতিদিন নিজেকে আবিস্কার করেন প্রকৃতির এক নৈসর্গীক সৌন্দর্যের মাঝে।