৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অপরাজিত বীরসেনানী আজিজুল হক ননী এখন জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক। যে টগবগে যুবক যৌবনে দেশ মাতৃকার টানে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নিলেও ফেরাতে পারেননি নিজের ভাগ্য। অভাব অনটন আর দারিদ্রতাকে সঙ্গী করে বর্তমানে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন আজিজুল হক ননী। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি পাক-বাহিনী কর্তৃক ধৃত হন। এরপর তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
পাকবাহিনীর সেলে নির্মম টর্চারিং এর মাধ্যমে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে তার পায়ের হাড়গুলি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং বেয়নেট দিয়ে সারা শরীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিণত করা হয় পঙ্গু মানবে। পঙ্গুত্ব নিয়ে এক সময় মুক্তি পেলেও দেশ নিয়ে তার চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। তিনি ভাবতেন দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের মানুষ মুক্তি পেয়েছে এর চাইতে বড় চাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনে আর কি থাকতে পারে। এবার নিশ্চয়ই পাক আমলে নির্যাতিত, নিপিড়ীত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্বাধীনতার পর তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ে চাকুরীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ সাড়ে সাত বৎসর কর্মসূত্রে ইটালির রোমে বাংলাদেশের দুতাবাসে চাকুরী করেন। ১৯৮০ সনে তিনি পুনরায় দেশে ফিরে কৃষি মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ঢাকার নিউ ইস্কাটনে একটি বাড়ী বরাদ্দ পান। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। উক্ত বাড়ীতে বসবাসরত থাকাবস্থায় একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা পেশী শক্তি বলে উক্ত বাড়ী জবর দখল করে। জীবনের সমস্ত উপার্জন এই বাড়ীতে রেখেই তাকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চোখের জলে রাস্তায় নামতে হলো। এ ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিনি চাকুরীচ্যুত হন।
স্ত্রী ও ৩ সস্তান নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় পথে পথে জীবনের প্রায় ২৫টি বছর অতিবাহিত করেন। ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জের একজন স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর গত ৫ বৎসর পূর্বে কিশোরগঞ্জ রেলষ্টেশন সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত বাড়ী অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ পান। দরজা জানালা বিহীন জরাজীর্ণ এই বাড়ীটিতে সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ থেকে পানি পড়ে। আয় উপার্জনহীন সংসারে একবেলা আধাপেটা খেয়ে কোন মতে দিন অতিবাহিত করেন।
তিনি বলেন, প্রতি বছর যথারীতি ১৬ ডিসেম্বর আসে, জনতা বিজয় স্তম্ভে ফুল দেয়, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানায়। মুখে মুখে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কথা বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। কিন্তু বাস্তবতা বড় ভিন্ন বড় ব্যতিক্রম। যে মুক্তিযোদ্ধার একবেলা খাবার জোটে না, চিকিৎসার অভাবে কঙ্কাল শরীর নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনে- মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হয়ত তার দাফন হবে। বিউগলে করুণ সুর বাঁজাবে, মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বগাথা উচ্চারিত হবে।
অথচ নিজের একটি আবাসস্থলে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারবেন কি না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় জীবনের শেষ ক’টি দিনগুলিতে তার মাথাগোজার ঠাইটুকু সংস্কার ও সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যেন এ বাড়িটি স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, তিনি যেন কোনক্রমে একবেলা আধবেলা খেয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো পার করে দিতে পারে এটাই এখন বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের নিকট আজিজুল হক ননীর একমাত্র চাওয়া।
Posted by Ab Emon