সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত আর্ন্তজাতিক র্যাংকিং লিস্টে প্রথম দিকে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান না পাওয়াটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ও মান যে অনেক নিচে নেমে গেছে তা এখন আর অস্পষ্ট নয়। এর পিছনের সব ধরনের কারণ খোঁজার জন্য কিছু গবেষণার প্রয়োজন আছে। কিন্তু গবেষণা ছাড়াও যে দু-একটা জুতসই কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, তা নয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, হয়তো আরো অনেকেই মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ খারাপ হওয়া বা আশানুরূপভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোয় গবেষণা না হওয়া, জ্ঞানের আবহ সৃষ্টি না হওয়া, দায়সারা ক্লাস নেওয়া ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদির পিছনে শিক্ষকদের আর্থিক অনটন ও তদ্ভব চিন্তা থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানের মধ্য বা বাইরে অতিরিক্ত একটু আয়ের চেষ্টা করা অন্য সব কারণ গুলোর চেয়ে বেশিই দায়ী।
এক্ষেত্রে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কোচিং সেন্টারে সান্ধ্যকালীন ক্লাস নেওয়া, বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে পার্ট-টাইম জব করে আর্থিক অনটন মেটানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্য কোথাও যুক্ত থেকে তাদের অর্থিক প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করছেন। তেমনি করে প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষকেরাও তাদের অপর্যাপ্ত বেতন দ্বারা যেসব প্রয়োজন অর্পূন থাকে সেগুলো প্রাইভেট-কেচিংয়ে পড়ানোর মাধ্যমে পূরণ করছেন। এতে করে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, সেটা সকলে বুঝেন। বাসায় প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষে পুরোটা না পড়িয়ে বা তাঁর পূর্ণ মেধা প্রয়োগ না করে কিছুটা প্রাইভেটের জন্য রেখে দিতে চাইবেন। আর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের মনোযোগ পড়ে থাকে দু জায়গায়। এতে করে তাঁদের জন্যও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। নিজ অফিসে বা বাসায় বসে গবেষণা, বা লেখালেখির সময় কমে যাচ্ছে সন্ধাবেলা আরেক বিশ্ববিদ্যালয় বা কেচিংয়ে ক্লাশ নেওয়ার প্রস্ততি নিতে ।
এটাই যেহেতু একটা বড় সমস্যা, তাহলে শিক্ষকদের নিজ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও যুক্ত হওয়া, ক্লাশ নেওয়া বা প্রাইভেট ও কোচিংয়ে পড়ানো আইন করে বন্ধ করা হোক। এমন পরামর্শ হয়তো বিভিন্ন মহল থেকে আসতে পারে। কিন্তু আসলে এটি কি কোন স্থায়ী সমাধান হবে? যত দিন তাদের আর্থিক যন্ত্রনা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানো না হবে ততদিন অবস্থার প্রকৃত কোন পরিবর্তন হবে না। আর এগুলো আদায় করার জন্য শিক্ষদের যদি দীর্ঘ দিন ধরে আন্দেলন করে তাঁদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হয় তাহলে কারা লাভবান হবেন আর কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা হিসেব করে নির্ধারণ করার প্রয়োজন হবে না। তবে তাঁদেরকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে আইনের মাধ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোথাও নিয়োজিত হওয়া থেকে নিবৃত করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়নের পথে আরেকটি বড় সমস্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ অন্যান্য বড় বড় কিছু পোস্টের রাজনীতিকরন ও সেগুলোতে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের বসানো। এ বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদন্ডকে যে কীভাবে ভেঙ্গে দিয়েছে তা গভীরভাবে চিন্তা না করলে বুঝতে পারা যাবে না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগসহ অন্যান্য সকল স্তরে অবক্ষয় শুরু হয়েছে। এই কারণে পোস্টগুলো থেকে মেধাবী আদর্শ বান শিক্ষকদের সরিয়ে রাজনীতিতে আশীর্বাদপুষ্ঠ শিক্ষকদের বসানো হয়েছে। ফলে শিক্ষক ও কমকর্তা নিয়োগের সময়ও প্রকৃত মেধাবী ও আদর্শবান ব্যক্তিদের নিয়োগ না দিয়ে ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে আশীর্বাদপুষ্ঠ আদু ভাই নেতাদের বা এম.পি মন্ত্রীদের আধা প্রতিবন্ধী ভাগনে, ভাতিজাদের বেছে নেওয়া হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশে মারাত্মক ক্যান্সার কোষ দিনের পর দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে; কমে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের মান ও মর্যাদা ।
এসবের সাথে ইদানিং আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। এটাও সরকরী বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অবনয়নে অবদান রাখছে। একটি গায়েবি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এর-ওর মুখ থেকে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অন্য কোন পেশায় চাকরি না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিচ্ছেন। এখানে চাকরি পাওয়াটা নাকি অত্যন্ত সহজ (অবশ্য যদি রাজনীতির আশীর্বাদ থাকে,বা কোন এমপি,মন্ত্রীর কেউ হন)। চাকরির জন্য নাম মাত্র মৌখিক পরীক্ষাতেই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ বোর্ডে পরিচিতজন থাকলে বা উপর থেকে কাউকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রোভিসিকে তদবির করলে চাকরি অনেকাংশেই নিশ্চিত। আর ভিসি বা প্রোভিসিগন আবার ওপর ওয়ালাদের কাছে কৃতজ্ঞ তাঁদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রেভিসি বানানোর জন্য।এভাবে গায়েবি গুঞ্জজনটিও ধীরে ধীরে সত্যি হয়ে যাচ্ছে। অন্য প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বা সমমানের পদবীতে চাকুরি পাওয়াও এত সহজ হয় না। সেগুলোতে পি,এস,সির মতো বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে আসতে হয়। তাই বলে সেখানে যে এমপি, মন্ত্রী ও রাজনীতিতে আর্শিবাদ পুষ্টদের দৌরাত্ম্য নেই এমন নয়।
বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি নানা ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ। ১০-২০ মিনিট মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীর আসল মেধার মূল্যায়ন যেমন সম্ভব হয়না তেমনি ৪-৫ জন কে নিয়ে গঠিত নিয়োগ বোর্ডে সাধারণত ভিসি বা প্রোভিসিগন যাদের নেওয়ার জন্য আগে থেকে আদেশ প্রাপ্ত তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে করে অনেক অযোগ্য লোক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে এর ভিতরে পরিবেশকে নষ্ঠ করছেন।
এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী ও বিশ্বাস যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু ১০-১২ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষা কোন ভাবেই যথেষ্ঠ নয়। স্ব স্ব বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা, শিক্ষকতা সম্পকির্ত বিষয়ে কিছু প্্রশ্ন সেট করা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য পি, এস, সির মত বা বর্তমান পি, এস, সির মাধ্যমেও এসব পরীক্ষার আয়োজন করে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করা যেতে পা্ের। ক্যাডার সার্ভিসে যেমন ক্যাডার পছন্দক্রম আছে সে রকম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে প্রার্র্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের পছন্দক্রম দিতে পারে। এতে করে প্রকৃত মেধাবীরা এ পেশার দিকে আকৃষ্ট হতে পারেন। তবে এখনও শ্রেণীর প্রথম সারির ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান যে করছেন না, তা নয়; তাদের সাথে কিছু অযোগ্য ছাত্রও প্রবেশ করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি সর্বোচ্চ সম্মানের স্থান হওয়া উচিৎ- আদর্শিক ও বাস্তবিক দুভাবেই। এখান থেকেই দেশের সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী প্রধানরা সহ সব পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের শিক্ষা অর্জন করেন। যে প্রতিষ্ঠানে আপনি পড়ালেখা করেছেন, যেখানে আপনার ছাত্রত্ব ছিল, সে জায়গাটা সবসময় আপনার কাছে একটি উৎকৃষ্ট জায়গা থাকতে পারলেই আপনি নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন, অন্যকে বুঝতে পারবেন। আর এ জায়গাটিকে কোনভাবে অপবিত্র, নীচু হতে দিলে, আপনার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তাঁর সম্মান রক্ষা করতে না পারলে আপনার নিজেরই যে অসম্মানিত হতে হবে। এটা সবার মনে রাখা উচিৎ। অন্যের করুনায় সিক্ত হয়ে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও এগুলোর শিক্ষদের সম্মান বাঁচাতে যেন না হয় সেজন্য তাঁদেরকে আত্ম-শক্তি অর্জন করতে হবে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা অত্যন্ত সম্মানজনক একটি পেশা। এ ধারনা যেন সকলের মধ্যে বদ্ধমূল থাকে। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অন্যান্য প্রশাসনিক পদগুলোর রাজনীতিকরন বন্ধ করতে হবে । রাজনৈতিক আশীর্বাদ বা তদবির কোন প্রকার নিয়োগ প্রক্রিয়াকে যেন প্রভাবিত করতে না পারে তার জন্য সমাজের ও দেশের সকল স্তরের মানুষকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত চিন্তা চেতনার কেন্দ্র। সেগুলোকে রাজনৈতিক আদর্শে তালাবদ্ধ করে রাখাটা জাতির জন্য কোন ভাবে মঙ্গল জনক হবে না ।
এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা তর্কাতীতভাবে অন্য যে কোন সরকারী কমকর্তা -কর্মচারীর তুলনায় বেশি করতে হবে নতুবা মানুষ তৈরি করখানা খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অদূর ভবিষ্যতে মেধাশূন্যতায় ভুগবে।