কোরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থবান নর নারীর উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। কোরবানী শুধু একটি ইবাদত নয়, বরং কোরবানীর মাঝে রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের উজ্জল দৃষ্টান্ত। এক হাদিসে এসেছে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন কোরবানীর দিনের আমল গুলোর মধ্যে পশু কোরবানী করার চেয়ে কোন আমল আল্লাহর অধিক প্রিয় নয়। কেয়ামতের দিন এ কোরবানীকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্ট চিত্তে কোরবানী কর (তির মিজিঃ ১৪৯৩)
অথচ বর্তমানে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি তার উল্টোটা মনে হয় যেন কোরবানীর এসেছে ভোগের জন্য। কে কত বেশি কবজি ডুবিয়ে খেতে পারে তার প্রতিযোগিতা রিতিমত বসে যায়। কোরবানীর ঈদের আগে আরেকটা বিষয় বেশ লক্ষ্য করা যায় তাহলো ফ্রিজ কেনা যাদের একটা ছোট ফ্রিজ আছে তারা আরেকটা বড় ফ্রিজ কিনবে। আর যাদের একটা বড় ফ্রিজ আছে তারাও আবার আরেকটা ডিপ ফ্রিজ কিনবে এটা যেন বাধ্যতা করণ কোরবানী দিয়ে গোশত জমাতে হবে এবং সেই গোশত সারা বছর খাওয়া হবে তাই। এবং ফ্রিজ এর শোরুম গুলো থেকে কোরবানীর ঈদের আগে ভাল ছাড় দেওয়া যেন সবাই সহজেই কিনতে পারে। যে পুরো টাকা দিয়ে কিনতে না পারে সে কিস্তিতে হলেও কিনে যে না পারে ধার করে হলেও ফ্রিজ কিনে। আবার কোরবানীর আগে ফ্রিজ ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে মোটামুটি খালিও করে রাখে গোশত জমা করার জন্য। প্রকৃত অর্থে এটা কোরবানীর প্রস্তুতি নয়।
আবার দেখা যায় পশু কিনা নিয়েও বেশ প্রতিযোগিতা চলে। কে কত বেশি বড় গরু কিনেছে, কয়টা গরু আর কয়টা ছাগল কিনেছে তারও পাল্লা চলে। কে কত বেশি দামী গরু কিনেছে তারও পাল্লা চলে। বড় গরু কিনে আবার এলাকায় ঘুরিয়ে দেখানো হয়। যার সামর্থ নাই সে ধার করে হলেও কোরবানী দেয় শুধু সমাজে মুখ রক্ষা করবে কিভাবে কোরবানী দিতে হবে, না পারলে ছোট হয়ে যাবে প্রতিযোগিতার বাজারে নিচে নেমে যাবে তাই ভেবে। যেটা নিয়মে নেই। অথচ আবার দেখা যায় সামর্থ্য আছে এমন অনেকেই কোরবানী দেয়না এ ব্যাপারে হাদিসে ধমক দেওয়া হয়েছে। যার সামর্থ্য আছে তাকে অবশ্যই কোরবানী দিতে হবে। সামাজিক অবস্থান বজায় রাখার জন্য, প্রতিযোগিতার জন্য বা পাল্লা দেওয়ার জন্য, বা লোক দেখানোর জন্য, বেশি করে গোশত খাওয়ার জন্য এসব কোনটার জন্যই কোরবানী নয়। কোরবানী অর্থ আত্মত্যাগ। ভোগ নয়।
আবার অনেকে দেখা যায় কোরবানী দিয়ে পাড়া প্রতিবেশী গরীব আত্মীয়-স্বজন এমনকি ফকির মিসকিনকেও ঠিকমত না দিয়ে সব ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। নিজেরা কসিয়ে রসিয়ে রসিয়ে খায়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আসলে বেশী করে খাওয়ায় আর বলে আরে খানতো বেশি খেলে কিছু হবেনা এটাতো কোরবানীর গোশত। আবার অনেকে রিতিমত বাড়ির গেইট বন্ধ করে রাখে যেন ফকির মিসকিন ঢুকতে না পারে। এমনকি বাড়ির দারেয়ানের হাতে লাঠি পর্যন্ত দেখা যায় ফকির আসলে তাড়ানোর জন্য। এমনকি চামড়ার বিক্রি করা ও টাকা নিয়েও বেশ তালবাহানা হয়। এটা নিয়ম নয় কোরবানী এজন্য আসেনি। ধনীর উপর গরীবের হক এবং অধিকার দুটোই আছে সেটা রক্ষা করতে হবে ভূলে গেলে চলবেনা। কোরবানীতে তাই মনে করিয়ে দেয়। আল্লাহতো সবাইকে গরীব করলেও পারতো কেন ধনী করেছে আবার গরীবও করেছে তা যদি আমরা বুঝেও না বুঝার ভান করি তবে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনবো। নিজের বুঝতো পাগলেও বুঝে তবে আমরা বুঝবোনা কেন।
পৃথিবীতে ধন সম্পদ এবং সন্তানাদি কিছুই আমাদের নয় সবটাই আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত ও পরীক্ষা সরূপ। চাইলে এক মুহুর্তে আল্লাহ কেড়েও নিতে পারে আবার দিতে পারে। সবাইকে তা বুঝতে হবে অহংকার ও দম্ভের যায়গা থেকে সরে এসে। এমন অনেক অসহায় আছে যারা চক্ষুলজ্জায় চাইতেও পারেনা আবার নিজে কিনেও খেতে পারেনা তাদের প্রতি আমরা বেশী দায়িত্বশীল হবো।
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর একটি হাদিস আছে “ভোগে জন্তু ত্যাগেই মানুষ”। অর্থাৎ যে ভোগ করে সে জন্তু আর যে ত্যাগ করতে পারে সেই প্রকৃত মানুষ। এই কথার সূত্র ধরে জোড় গলায় বলবো আমরাতো মানুষ ত্যাগই যদি করতে না পারি তবে মানুষ হলাম কিভাবে। আমরাতো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব সম্মানিত মানুষ। অথচ আমাদের ভোগের অবস্থা দেখে একণ জন্তুও হাসে, হাসবেইতো আমরা শুধু খাই খাই, নাই নাই, পাই পাই, এই করে যাচ্ছি। কি পেলাম কি খেলাম কতটুকু পেলাম আরো কত দরকার শুধু এই করি এই ভাবি। কতটুকু আল্লাহর হুকুম মানলাম আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলাম, অন্যের জন্য ভাবলাম, অপরকে কতটুকু দিতে পারলাম সেই হিসেব আর ত্যাগ কেউই করতে পারছেনা। পাওয়ার নেশায়, খাওয়ার নেশায়, লোভের নেশায়, ভোগের আসায় সবাই পাগল পারা হয়ে আছে। এটা ত্যাগের শিক্ষা নয় ভোগের যা মানবীয় গুনাবলীর মধ্যেই পড়েনা।
হাদীসে আরেকটি কথা আছে নীচের হাত অপক্ষো উপরের হাত উত্তম। অর্থাৎ যে দান করে তার হাত উপরে থাকে আর যে নেয় তার হাত নিচে থাকে আমরা জেনে শুনে উত্তম থেকে কেন অধম হবো? আমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব সম্মানিত মানুষ উত্তম কাজ করবো উত্তম পথে চলবো। অন্যকে ভালোবাসার মাঝে, দেওয়ার মাঝে, ত্যাগের মাঝে সত্যি আত্ম তৃপ্তি আছে। মানসিক প্রশান্তিও আছে।
কোরবানী আমাদের ত্যাগের মহিমা শিখায় ভোগের নয়। অনেকে কোরবানী দিয়ে ময়লা যেখানে সেখানে ফেলে রেখে পরিবেশ নষ্ট করে অন্যকেও কষ্ট দেয়। এটা কোরবানীর শিক্ষা নয়। পশু কোরবানী দিয়ে নিজের ভিতরের পশুত্বকে মেরে ফেলতে হবে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করতে হবে এটাই প্রকৃত কোরবানী। সৌদিআরবেও প্রতি বছর কোরবানী হয় হাজিরাও কোরবানী দেয় তারা সেই গোশত জমা করে বসে খায়না তারা প্রকৃত অর্থে কোরবানী দেয় এবং সেই দুম্বার গোশত পরবর্তীতে আবার বাংলাদেশে ও আসে আর সেই গোশত নিয়ে আবার অনেকের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। যাদের জন্য আসে যাদের ঐ গোশত পাওয়ার কথা তারাই পায়না। তবে আমরা পাশের দেশ থেকেই বা কি শিখলাম? খাওয়া না অপরকে বিলিয়ে দেওয়া?
আমি আবারো বলবো কোরবানীর অর্থ ভোগ নয় ত্যাগ। আমরা সবাই প্রকৃত অর্থে কোরবানী দেবো। এবং অর্থ বুঝে জেনে শুনে আল্লাহর নির্দেশ পালন করবো এবং সেই শিক্ষা সবাই গ্রহণ করবো। যার সামর্থ্য আছে সে কোরবানী দিবো যার সামর্থ্য নেই সে জোড় করে ধার করে লোক দেখানোর চেষ্টা করবোনা। কোরবানী অর্থ কি আগে সেটা সবাই উপলব্ধি করবো। তার পর প্রস্তুতি নিবো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোরবানী দিবো হালাল ভাবে। আমরাও খাবো তবে নিজের ভাগের টুকুই খাবো তার বেশি নয়।