একটা বৌদ্ধ মন্দির। সেই মন্দির থেকে ভেসে আসছে ছোট্ট বৌদ্ধ শিশু শ্রমনের মুখে গৌতম বুদ্ধের অহিংসা বাণীর সুর। আর মন্দিরের পাশে কৃষ্ণচুড়া গাছের লাল টকটকে ফুলগুলো ছড়িয়ে পড়ছে নিচের চারদিকে। সেই গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে বেড়াতে আসা কয়েকজনতরুণ-তরুণী। অন্যদিকে শেফালি ফুলের গন্ধও মাতোয়ারা করে দিচ্ছে সবাইকে। বৌদ্ধ পূর্নিমাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে ঢল নামছে শত শত পূন্যার্থীর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বশান্তি প্যাগোডার চিরচেনা দৃশ্য এটি। একটি ছাত্রাবাস, একটি জাদুঘর, এবং একটি বৌদ্ধ মন্দির মিলে নাম হয়েছে “বিশ্বশান্তি প্যাগোডা।” তবে সবার কাছে এটি প্যাগোডা নামেই পরিচিত। ছাত্রাবাসটি মূলত বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। মূল ক্যাম্পাস থেকে একটু দূরে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেটে জোবরা গ্রামেই এ প্যাগোডা অবস্থিত। এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের একমাত্র উপাসনালয়। প্যাগোডার মূল আকর্ষণটা কিন্তু এর স্থাপত্যকে ঘিরে। লাল ইট দিয়ে নির্মিত কমপ্লেক্সটিতেই মাখানো রয়েছে সব সৌন্দর্য। প্যাগোডার পাশে প্রায় ৭০ ফুট টাওয়ার উপর থেকে প্যাগোডাকে দেখলেই মনে হয় যেন এটি থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারের কোন বৌদ্ধ মন্দির। জানা যায়, অসাধারণ কারুকার্যে নির্মিত এই প্যাগোডাটির নির্মাতা বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু প্রয়াত মহামান্য সঙ্ঘরাজ শ্রী জ্যোতিপাল মহাথের। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ শুরু হয় এবং যাত্রা শুরু হয় ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে। গোবিন্দ গুনালংকার বৌদ্ধ ছাত্রাবাসটির নির্মাণে অর্থায়ন করেন ইতালির রেডক্রস, নকশাকার ছিলেন স্থপতি সাইফুল হক। এ এবং বি, দুই ব্লগ বিশিষ্ট এই প্যাগোডায় ১৯৯৬ সালে এ ব্লকে প্রায় ৭০ জন ছাত্রের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। আর ১৯৯৮ এর দিকে ‘বি’ ব্লকে বসবাস শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। দুই তলা বিশিষ্ট প্রত্যেক ব্লকের সামনে রয়েছে লাল ইট দিয়ে থরে থরে সাজানো একটি করে উঠান। সেই উঠানগুলোতে লেখাপড়া থেকে শুরু করে খেলাধুলা সবকিছুই করা যায়। বর্তমানে গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাসটিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ প্রায় ১০০ জনের মত আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে বলে জানান প্যাগোডার তত্ত্বাবধায়ক অলকেশ বড়ুয়া। আর রয়েছে শ্রী জ্যোতিপাল মহাথের’র স্মৃতি জাদুঘর। প্রায় প্রতিদিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের অনেক সৌন্দর্য-পিপাসু দর্শনার্থী ছুটে আসে এই প্যাগোডায়। আর ফিরে যায় প্যাগোডার সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে। তাদের মধ্যে কথা হল সৌরভ ও তানজিনার সাথে। সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সৌরভ জানান ‘প্যাগোডায় কেন আসি তা বলতে পারব না, তবে এর সৌন্দর্য যে আমাকে মুগ্ধ করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’ ‘চারদিকে নিরব নিস্তব্ধতা যেন আসল শান্তির রুপ’ বলে মনে করেন একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তানজিনা। প্যাগোডায় প্রায় চার বছর ধরে বসবাস করছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী বোঅংসিং মারমা। হলে না থেকে এখানে থাকছেন কেন, এমন জানতে চাইলে তার হাসিমাখা উত্তর, ‘প্যাগোডায় থাকতে থাকতে প্যাগোডার প্রেমে পড়ে গেছি, আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি দিনটাও এখানেই শেষ হোক’ বললেন তিনি। প্যাগোডা প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ছিলেন রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলায় বাঙ্গালহালিয়া কলেজের অধ্যাপক উদয়ন মহাথের। প্যাগোডা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে বিভিন্ন জীব বৈচিত্রই ছিল প্যাগোডার মূল সৌন্দর্য, এ সময় মায়া হরিণ, বন্য শুকর প্রবৃত্তি প্রাণীগুলো এখানে নির্ভয়ে বিচরণ করত। তাদের সেই চলাফেরা এবং ডাকাডাকির কোলাহলে মুখরিত হয়ে যেত পুরো প্যাগোডা।’ একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে এর স্থাপত্যের নান্দনিকতা। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে সম্প্রীতির অপূর্ব বন্ধন যেন ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকে। সেই সাথে গৌতম বুদ্ধের ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ এই অহিংসার অমৃত বাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক এমনটা প্রত্যাশা এখানকার বেড়াতে আসা দর্শনার্থী এবং প্যাগোডা সংশ্লিষ্ট সকলের।