ফকির লালন। অনেকেই বাউল ফকির লালন বলেন। কিন্তু তিনি বাউল নন। তিনি কোন সাধারণ গায়কও নন। অনেকেই তার গানকে ভালবেসে গান করে থাকেন। লালন একটি আদর্শ, একটি দর্শন। লালনের গান শুধু গান নয় সেগুলো হচ্ছে বাণী। প্রায় দুইশ বছর আগের তার দর্শন, ভাবধারা, জীবনাচার এখনও মানুষকে ভাবিত করে। এই সময়ে বরং তার সেই বাণীগুলোর বাস্তবতা আরো বেশি সমসাময়িক। তাকে নিয়ে এ পর্যন্ত হয়েছে বিস্তর গবেষণা। সে গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। তার জাত-পাত নিয়েও রয়েছে রহস্য। কিন্তু সবকিছু থেকেই তিনি উর্দ্ধে। বর্তমান সময়ে সেই কুষ্টিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তবে এদেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে নিয়ে যেভাবে গবেষণা হয়েছে তার কানাকড়িও তাকে নিয়ে এখানে হয়নি। অথচ আমাদের লোকসঙ্গীতকে খুঁজতে গেলে সবার আগে লালনের নামই চলে আসে। লালন এদেশের অনেক বড় ভাব সম্পদ। তাই আমাদের প্রশ্ন ছিল এই সময়ে লালনকে নিয়ে শহুরে চর্চার অবস্থান। এর প্রভাব ও সুফল, কুফল। প্রশ্নের উত্তর আমরা কয়েকজন লালন গবেষকদের কাছ থেকে নেয়ার চেষ্টা করেছি। লালন গবেষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রিয়.কমের মাহমুদ উল্লাহ।
ফরিদা পারভীন: আগে লালন সাইঁজীর আখড়ার আশেপাশে লালনের তড়িকাপন্থীরা ভিক্ষা করে বেড়াতো। এখন তারাই আবার ইউরোপ আমেরিকায় গিয়ে লালন গাইছে। তাদের গানে এক ধরনের গ্রাম্যতা আছে। অথচ প্রতিটা গানেরই একটা মসৃনতা আছে। সেই গ্রাম্যতাকে ঝেড়ে একটা মসৃনভাব নিয়ে এসেছে এই শহুরে লালন চর্চা। এটা অবশ্যই একটি ভাল দিক। সর্ব প্রথম লালনকে পরিচয় করিয়ে দেন মোকশেদ আলী সাঁই। লালন সঙ্গীত শিখতে হলে গুরু ধরে শিখতে হয়। সিডি ক্যাসেট শুনে লালন সঙ্গীত চর্চা হয় না। সাবিনা ইয়াসমীনও আমার কাছে লালন সঙ্গীত শিখতে এসেছিলেন।
এখন অনেক নব্য গবেষক হয়েছেন যারা লালন চর্চা করেন। তবে লালনের ভাববাদী গান দীর্ঘস্থায়ী চর্চার বিষয়। কোনমতে গেয়েই বলে ফেললাম আমি লালন গাই, তা ঠিক না। পরিশীলিত গলায় লালন চর্চা করতে হবে। তবেই শহুরে লালন চর্চার প্রভাবটা ভাল হবে। দেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে নিয়ে যেভাবে চর্চা হয়েছে সেভাবে লালনকে নিয়ে হয়নি। তবে এখন ছোটছোট বাচ্চারাও লালন চর্চা করছে, বাবা মায়েরা তাদেরকে লালন চর্চা করাচ্ছেন এটা ভাল দিক। আর কুষ্টিয়ায় যারা লালন চর্চা করেন অনেকেই আছেন আগে ঢাকা শহরও দেখেননি। এমনকি জীবনের প্রথম ট্রেনে চড়েছেন এমন ফকিরও রয়েছেন। তারা পৃথিবীর অনেক শহরে যাচ্ছেন। তবে টাকার মোহে পড়ে নিজের সম্মানটুকু খোয়ালে চলবে না। এইসব দিকে সেইসব ফকিরদের সাবধান থাকাটা উচিৎ। আমি স্রোতে গা ভাসানো মানুষ না। একজন মানুষ যদি শুধু লালনের একটি বাক্যও মনে ধারন করে তবেই তার আর কোন সমস্যা হবে না। ‘সত্য বল, সুপথে চল, ওরে আমার মন।’
সায়মন জাকারিয়া: সেই ৬০ এর দশক থেকে লালন চর্চার একটা আবহ চলছে। মোকশেদ আলী সর্ব প্রথম লালনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এর আগে রবীন্দ্রনাথ একভাবে লালনের কথা বলেছেন। ফরিদা পারভীনও নগরে লালনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া ইউনেস্কো তার একটি প্রজেক্ট করেছিলো, ‘অ্যাকশন প্লান ফর দ্যা সেভ গার্ডিং অব বাউল সং’ নামে। সেটা ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত চলে। বর্তমান লালনকে নিয়ে আরবান চর্চার দুটি দিক রয়েছে, একটি ভাল অন্যটি খারাপ। খারাপ দিকটি হলো এই গানের ধারক বাহক যে বাউল শিল্পীরা, যারা লালনকে বুকে ধারন করে রেখেছে এখনও। তাদেরকে এই শহুরে চর্চাকারীরা মনে রাখছে না। তারা একভাবে গেয়ে যাচ্ছে।
অরুপ রাহি: যখন সমাজে বিভেদ, ধর্মীয় উম্মাদনা বেড়ে যায় তখনই শহরে লালনের বাণীগুলোকে মনে করা হয়। এটা ভাল। তবে শহরে যারা লালন চর্চা করেন তাদের লালনের সেই দার্শনিক বোঝাপড়াটা নেই। এটা ঠিক না। শহরে লালন চর্চা এখন একটি ব্রান্ড। হাতের রিস্টওয়াচে বা টি-শার্টে লালনের ছবি বিক্রি হয় অনেকটা চেগুয়েভারার মতো। লালনকে এখন পন্য আকারে সেল করা হচ্ছে। তাই আমার কথা হচ্ছে লালনকে পণ্য আকারে নয় একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হলে লালনকে গভীরভাবে চর্চা না করলে বা তার দর্শনকে না বুঝলে চলবে না। তার দর্শনকে ঠিকভাবে চর্চা করতে পারলে আমাদের সমাজকেই বদলে ফেলা সম্ভব। লালন আমাদের সম্পদ। বর্তমান গণমাধ্যম তাকে দূর্বলভাবে উপস্থাপন করছে। তাকে চর্চা করার জন্য যে নিমগ্নতা প্রয়োজন তা শহুরে চর্চাকারীরা কোথায় পাবে। তাই আমার কথা নাগরিক জীবনে তার চর্চা কোনভাবেই কাঙ্খিত রুপে হচ্ছে না