জীবন থাকলে সম্পর্ক থাকবেই। আর সম্পর্ক থাকলে থাকবে সমস্যা। প্রতিদিন ফেসবুকের ইনবক্সে ও ই-মেইলে আমরা অসংখ্য সম্পর্ক ভিত্তিক প্রশ্ন পাই, যেগুলোর কথা হয়তো কাউকেই বলা যায় না। পাঠকদের করা সেইসব গোপন প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমাদের নিয়মিত আয়োজন। আর সম্পর্ক ভিত্তিক সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরে পরামর্শ দিচ্ছেন গল্পকার রুমানা বৈশাখী, এডিটর ইন চার্জ (লাইফ ও সায়েন্স),।
আপনি চাইলে নিজের এমনই কোন একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যার কথা লিখে জানাতে পারেন আমাদের। আমরা প্রতিদিন চেষ্টা করবো বাছাইকৃত কিছু সমস্যার সমাধানে কাঙ্ক্ষিত পরামর্শটি দেবার। সমস্যার কথা লিখে জানান আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। নাম গোপন রাখতে চাইলে লিখে দেবেন “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক”।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন নিজের সমস্যার কথা।
“আপু, আমার বিয়ের প্রায় দশ বছর। আমরা সাত বছর প্রেম করে বিয়ে করি। তখন সে আমাকে অনেক ভালবাসত। আমার প্রেমে অনেক বাঁধা আসে। সে কিছুই করত না। সামান্য ব্যবসা করত। তবে তার মিউজিক এর প্রতি নেশা ছিল।এখনও আছে। কমার্শিয়াল মিউজিক করত। রাত বিরাত বাইরেও থাকত।
আমি অনার্স ১ম বছরে পড়াকালীন সময়ে আমার বিয়ে হয়। তার অনেক রাগ। রেগে গিয়ে একবার ঘুমের পিল খেয়ে মেডিক্যাল থেকে ওয়াশ করে আনতে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে চাইত আমি মা-এর বাসায় থাকি। পড়াশুনা করার জন্য আর তার রাতে মিউজিক করে সংসার চালানর জন্য হলেও আমি আর আমার বড় ছেলে মায়ের এখানে থেকেছি। প্রায় ঝগড়ার সময় বলত- চলে যা। অনেক বাজে কথাও বলত। একবার আমি প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় আমার গলা চেপে ধরে। তখন আমি শুধু কান্না করে দিন কাটিয়েছি। মার বাসা থেকে একদিন সকালে আমার বাসায় এসে তার ফোনে মেসেজ দেখি এক মেয়ে লিখেছে- তুমি কখন সিলেট থেকে এসেছ ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। তখন সে শুয়ে ছিল। এটা নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়। ওর বোনের কাছে আর কাছে নালিশ করলে বলেছে ওর ভাই এমন না। ওর বন্ধুদের কাছেও জানাই। ওদের কাছে বলেছে আর এমন হবে না।
তারপর আমি তাকে সুযোগ দেই ভাল হতে। সব ভুলে সংসার করি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়য় থেকে এমবিএ করি। এর মাঝে অনেক ঝগড়া হত। এর মাঝে তাকে আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হত। একবার তার বুকে আমি দাগ দেখি। কেমন দাগ বুঝতে পারছেন আপু? জিজ্ঞাস করলে বলেছে, গাড়িতে গিটারের চাপে হয়েছে। এর মাঝে আমি তার ফেসবুক আইডি আর ফোন দেখলে অনেক রেগে যেত। তবে আমার অসুখ হলে আমার খেয়াল রাখত। সাধ্যমত সব দিতে চেষ্টা করত। আমার ও তার পরিবারের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে তার চোখে আমি সেই প্রেম দেখি না। সব দায়িত্ব পালন করে সে। বেড়াতে নিয়ে যেত, তবে আমার জোরাজুরিতে। নিজে থেকে আমাকে নিয়ে কোন প্ল্যান ছিলো না। এর মাঝে তার টিভি চ্যানেলে চাকুরি হয়। আমার একটা মেয়ে হল। আমার এমবিএ শেষ হল।
একবার তার জামায় বড় মেয়ের চুল দেখি। মেয়ে হওয়ার দুই মাস পরে সে আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে, তাও আমার বলাতে। এর মাঝে তাক আমি সন্দেহ করি। কিন্তু প্রমাণ না পাওয়ায় কিছু বলতে পারি না। আবার মনে করি আমার চোখের ভুল বোধহয়। মেয়ে হওয়ার দুই মাস পর তার জন্মদিনের দিন একটা মেয়ের ফোন আসে আর মেয়েটা শুনে অবাক হয় যে সে বিবাহিত। অনেক কথা বলে। এটা নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু এইবার স্বীকার করে। কিন্তু বলে ঐটা নাকি ওয়ান সাইড রিলেশন ছিল। মেয়েটা ফোনে কান্না কাটি করে আমার কাছে। আমার স্বামী মাঝে মাঝে অনেক দামি গিফট নিয়ে আসতো ঘরের জন্য। কিন্তু পরে শুনি এগুলো ঐ মেয়ের দেয়া। অন্য আরেকটা মেয়ে ফোনে অনেক কথা বলে, বলে যে তারা নাকি বিয়ে করেছে। কিন্তু আমার স্বামী বা ঐ মেয়ে বলে করেনি। তবে অনেক কিছু স্বীকার করেছে। কিন্তু পরিস্কার করে কিছুই বলত না। চুপ থাকতো। দুই দিন পর বলল, আজকের পর থেকে তুমি থাকবা। এরপর আমি তাকে অনেক সময় দেই। তবে জিজ্ঞেস করলে অনেক ঝগড়া হত, আমাকে কোরআনের কসম কাটায় আমি যেন ঐ প্রসঙ্গ না তুলি।
এরপর আমি কিছুদিন জব করি। এখন আমার দুইটা বাচ্চা আছে। ভালবেসে বিয়ে করেছি। তাকেও খুব ভালবাসি। তাদের বড় বাড়ি আছে। তার চাকরী আছে। এগুলোর অনেক দাপট দেখায়। বাচ্চাদের দেখার কেউ নাই তাই জব ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাকে কথা শুনায় যে আমার কিছু হয়না,আমার মা-বাবা ফকির। বলে রাখি আপু,আমি তাকে অনেক টাকা ধার এনে দিয়েছি। ও টাকা শোধ দিয়ে দিত। কিছুদিন আগেও ফেসবুক চেক করে এক মেয়ের সাথে কথা বলেছে দেখতে পাই। তবে আমি বুঝি না এটা ওই মেয়ে কিনা। তবে কেন জানি মনে হয় সে আমাক মিথ্যা বলে, লুকায়। এখন ওই প্রসংগ আনলে বলে এমন কিছু কোনদিন ছিলো না।
আপু, আমার এই বিভ্রান্তিকর জীবন ভাল লাগে না। আমাকে প্লিজ জানাবেন আমি কীভাবে বুঝব তার ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে কিনা? বলে রাখি, সে সবসময় মানুষের কাছে আমার বদনাম করে। তবে সব দায়িত্বই পালন করে আমার। আপু, আমি খুব মানসিক চাপে আছি। আমাকে একটু জানান আমি কী করব? আমি আমার সংসার ফেলে যেতে চাই না। কীভাবে তাকে ধরব? কীভাবে তাকে আমার আগের ভালবাসার মানুষ হিসেবে ফিরে পাব?
গত ৫ বছর আমি খুব মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছি। কিছুদিন পর পরই আমার চিন্তা হয়,তার কি ওই মেয়ের সাথে এখন রিলেশন আছে? আপু, একটু জানাবেন। মা আর আমার বোন কে আমি আর এসব জানাতে চাইতে না। তারা আমার জন্য যা করেছে তাই অনেক।”
পরামর্শ:
দেখুন আপু, আপনি নিজেই যদি বলতে থাকেন যে এটা পারবো না, সেটা হবে না, এটা চাই না… তাহলে আপনার কোন সমস্যারই সমাধান হয় না। আপনার এটা বুঝতে হবে যে জীবনে সব কিছু পাওয়া যায় না। আর মাঝে মাঝে আমাদের শান্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে কিছু না কিছু স্যাক্রিফাইস করা।
একটা সহজ কথা বলি, আপনার জায়গায় আপনি হলে এই সংসার আমি কখনোই করতে পারতাম না। কারণ আপনার স্বামী যা করেছেন, তার ১০ ভাগের একভাগও কেউ আমার সাথে করলে আমি সম্পর ত্যাগ করতাম। কেন? কারণ ভালোবাসা দুজনের ব্যাপার। একজন যখন পরকীয়া করে, তাহলে আর সেটা ভালোবাসা থাকে না। আর ভালোবাসাই যদি না থাকে, তাহলে সম্পর্ক রেখে লাভ কী? আপনি বলে পেরেছেন, আমি পারতাম না এই কষ্ট মেনে নিতে। তবে হ্যাঁ, কখনো কখনো আমরা বাধ্য হয়ে মেনে নিই হারাতে চাই না বলে। আপনার ব্যাপারটিও তেমন।
আপু, মিডিয়ায় বা শো বিজনেসে জড়িত মানুষদের সংসার টেকে না, এমন কথা বহু আগে থেকেই প্রচলিত। আমি নিজেও বহু বছর যাবত এসবের সাথে, বিশেষ করে এই মিউজিক্যাল শো করার ব্যবসায় জড়িত ছিলাম। নিজে চোখের সামনেই দেখেছি যে ব্যাপারটা আসলে অনেকটাই সত্যি। কারণ এখানে মেলামেশার সুযোগ অনেক বেশি। শো বিজনেসে জড়িত মানুষদের প্রতি সাধারণ মানুষদের আগ্রহও বেশি। আর রাত বিরাতে যখন একসাথে কাজ হচ্ছে, একটা সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে না। সেটা যৌন সম্পর্ক হলেও। আপনার স্বামীর ক্ষেত্রেও এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে তার অন্য মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল এবং আছে। তাও একাধিক মেয়ের সাথে। নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে সে একাধিক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। হয়তো ভবিষ্যতেও করবে। আর ওই মেয়েটির সাথে সম্পর্ক যে নিজে ভাঙ্গেনি। খুব সম্ভবত মেয়েটিই আপনার স্বামী বিবাহিত দেখে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তাই আপনার স্বামী বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছিলেন আর ওই প্রসঙ্গ শুনলে রেগে যান।
আপনি সবচাইতে বড় ভুল তখনই করেছেন। যে মানুষ এমন একটা কাজ করতে পারে, আপনি কীভাবে তারপরও সংসার চালিয়ে গেলেন? আপনার প্রতি তিনি যে দায়িত্ব পালন করেন, সেটা আপনি তার সন্তানদের মা হিসাবে ও সমাজের চোখে পরিষ্কার থাকার জন্য। আপনার তখনই উচিত ছিল সমস্ত তথ্য প্রমাণ সহ দুই পরিবারের মুরুব্বীদের সামনে ব্যাপারটা উপস্থাপন করা এবং পারিবারিক ভাবে চাপ দিয়ে শুধরে যেতে বাধ্য করা। পরকীয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না বলে পরকীয়া হচ্ছে না, আপনার স্বামীর ব্যাপারটা এখন তাই। সেটা আপনার সাথে তার খারাপ ব্যবহারের নমুনা শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
যেহেতু সংসার ফেলে যেতে চান না, আমার মনে হয় এই “ধরাধরির” চেষ্টা না করাই ভাল। কারণ আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসবে। হয়তো এমন একটা জিনিস জানতে পারবেন যে সংসার না ছেড়ে উপায় থাকবে না। তার চাইতে চুপ থাকাই ভালো, অযথা আবর্জনা ঘেঁটে লাভ নেই। কারো যদি চুরি করার ইচ্ছা থাকে, তাকে বেঁধে রেখেও লাভ হয় না। আর ইচ্ছা না থাকলে শত প্রলোভনেও কাজ হয় না। দেখুন আপু, আপনার স্বামী আপনাকে কখনো আগের মত ভালবাসবে, আপনার জন্য জানপ্রান দিয়ে দেবে, এমন অলীক আশা না করাই ভালো। হুট করে এমন কিছু ঘটবে না। হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন হলে সম্পর্ক আবার ঠিক হতে পারে।
ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে? আপনি নিজে কিছু করার চেষ্টা করুন আপু। নিদেন পক্ষে একটা পার্ট টাইম জব বা ঘরে বসে কিছু করা যায়, এমন হলেও। ভবিষ্যতের কথা কেউ বলতে পারে না তাই নিজেকে পরনির্ভর করে রাখবেন না। ব্যস্ত থাকলে মানসিক অশান্তিও কম হবে। আর স্বামীকে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সম্পর্ক খারাপ করবেন না। বর্তমানের সম্পর্ক উন্নয়নেই মন দিন। আপনার জন্য না হোক, বাচ্চাদের জন্য যেন মমতা অটুট থাকে সেই খেয়াল করুন। তাতে অন্তত সংসার বাঁচবে।