মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের রায় তাদের শোনানো হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বাকি মাত্র। তবে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি আইনসম্মত নয় এবং আসামিরা আবেদন করবেন না-এ যুক্তিও সকলের কাছে স্পষ্ট। সব মিলিয়ে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন ফাঁসির মঞ্চের সন্নিকটে।
অনেকে জল্পনা-কল্পনা শুরু করেছেন আজ বৃহস্পতিবার রাতেই হয়ত তাদের ফাঁসি হবে। কিন্তু শুক্রবার মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা। অনেকে শুক্রবার ফাঁসির কথা কল্পনা করলেও দিনটি ভালো বিধায় এদিন ফাঁসি না হওয়ার সম্ভাবনার কথাই ভাবছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী আসামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করতে পারেন না। কারণ, তাদের বেলায় জেলকোড প্রযোজ্য নয়। তাদেরকে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হলেও আসামীদের কারণে সে পথও রুদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে গেলে অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে। কিন্তু আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেদের বার বার নির্দোষ বলেছেন। সব মিলিয়ে এখন সরকারের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা।
এদিকে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের ব্যাপারটি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বৃহস্পতিবার রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম এ কথা বলেন। আর এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা ছাড়া দেশের তাদের আর কোনো আবেদনের সুযোগ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মানবতাবিরোধী অপরাধী সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির সাজা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপিতে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতিসহ রায় প্রদানকারী চার বিচারপতি আলাদাভাবে সই করেছেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
দুই রায়েই বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি অথবা আইনের বত্যয় বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।
কিন্তু অপরাধীর পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। এমনকি সাকা চৌধুরী সার্টিফিকেট পর্যন্ত জালিয়াতি করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালান। কিন্তু এ যাত্রাও রেহাই পাননি তিনি।
বিচারপতিদের সই করা সেই কপি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছালে সাকা ও মুজাহিদকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। এখন শুধু সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে আর কতদিন তারা পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেন।
এদিকে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মুজাহিদের সাথে শুক্রবার সাক্ষাৎ করার সময় চেয়ে আবেদন করেছেন তার আইনজীবীরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে এই আবেদন করেন তারা। বলেন, ‘পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে মুজাহিদের সাথে দেখা করব। এ জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন দেওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলে কাল সকালে তার সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করা হবে।’
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় এ বছর ২৯ জুলাই আপিলের রায়েও বহাল থাকে।
তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একইদিন, ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দু’জনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং কারা কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর তা দুই ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনায়।
এরপর দুই যুদ্ধাপরাধী ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন আপিল বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে গত বুধবার আদালত তা খারিজ করে দেন।
দণ্ড কার্যকরের আগে দুই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
এখন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে শেষ সুযোগে দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। আসামি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে।
রিভিউ খারিজ হয়ে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথমে সাকা চৌধুরী ও পরে মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দেখা করেন।
অবশ্য এর আগে দণ্ড কার্যকর হওয়া দুই যুদ্ধাপরাধীর ক্ষেত্রে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি ফয়সালা হওয়ার পর তাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে আরও একবার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাত করতে দেওয়া হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার সাক্ষাৎ শেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর সাকা চৌধুরীর ভাই জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে সাংবাদিকরা প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে জানতে চান। জবাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘কী, মার্সি পিটিশন?’
একই প্রশ্নে মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, ‘তিনি (বাবা) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি আমাদের রাষ্ট্রের ও জনগণের অভিভাবক। তিনি একজন আইনজীবীও।’ সুতরাং তার কাছে আবেদন করব কি-না আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব।’
এদিক সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার একদিন বাদে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিএনপি বলেছে, তাদের নেতা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ শিকার। আর মুজাহিদের ফাঁসির রায় পুর্ণবহাল থাকার পরের দিন জামায়াত সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে, যদিও হরতালে জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি।
এর আগে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন এক দিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়েছিল।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।
আর চলতি বছর ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য আসামি ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, একটি দরখাস্ত লিখতে যে সময় লাগে-‘যৌক্তিক সময়’ তার চেয়ে বেশি হওয়া উচিৎ নয়।