পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের পেছনে রাজনীতি, অভিভাবকদের আর্থিক অক্ষমতা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দায়ী করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সংস্থাটি ২০১৪ সালের জন্য বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতা তুলনামুলক বেশি থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের চাহিদা বেশি। এ প্রেক্ষাপটে কিছু শিক্ষক একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করে থাকেন। এতে নিজ প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সময় দেওয়া হয় না। এর ফলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন বাড়ছে সেশনজট। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪-তে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
যে কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে ইউজিসি’র প্রতিবেদনটিতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেশনজটের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সেশন বহুগুণে পিছিয়ে পড়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এতে করে মানবসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তবে সেশনজট সৃষ্টির সবক’টি কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নয় এবং তা নিরসন করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের একক কর্তৃত্বাধীন নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি কারিকুলাম বাস্তবায়নের পদ্ধতি, বিশেষ করে পরীক্ষা পদ্ধতি এবং পরীক্ষার ফল প্রকাশে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বকে সেশন জটের জন্য বহুলাংশে দায়ী করা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতি যুগোপযোগী করে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রতিআহ্বান জানানো হয়েছে ইউজিসির পক্ষ থেকে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তির সুযোগ পায়। তাদের বেতন এবং আবাসিক হলের সিট ভাড়া নগণ্য হলেও একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রমসহ দৈনন্দিন জীবনে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, বেশিরভাগ অভিভাবকের পক্ষেই সে পরিমাণ অর্থ যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকার থেকে যে পরিমাণ বৃত্তির অর্থ প্রদান করা হয়, তা একেবারেই অপ্রতুল। ফলে খরচ মেটানোর জন্য অধিকাংশ শিক্ষার্থী গৃহশিক্ষকতার পেশায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। এতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে এবং তাদের মধ্যে পরীক্ষা পেছানোর প্রবণতা জেগে উঠে। এই প্রবণতা বুয়েটসহ বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জটের একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছে ইউজিসি।
এ সমস্যা সমাধানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি প্রবর্তন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যাতে বৃত্তির অর্থ তার পড়াশোনার ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট হয়।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যোগ্যতা সাধারণ বিবেচনায় অত্যন্ত উঁচু মানের। বেশিরভাগশিক্ষকই নিষ্ঠাবান; তাঁদের অবদান জাতীয় উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে কিছু সংখ্যকশিক্ষকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষককে প্রতি সপ্তাহে কত ঘণ্টাক্লাস নিতে হবে−এ ব্যাপারে নিজস্ব নিয়ম থাকলেও এর সঠিক বাস্তবায়ন হয় নাবলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাডেমিক সেশনে অর্থাৎ প্রতি বছর ৩০-৩২ সপ্তাহ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় এবং বাকি সময় ছুটি থাকে। ক্লাস নেওয়া ব্যতীত অন্যান্য কাজের জন্যে যেমন-গবেষণা, প্রশাসন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা ইত্যাদি কাজের জন্য কত সময় একজন শিক্ষককে তাঁর কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান না থাকায়, অনেক শিক্ষকই বেশিরভাগ সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিতথাকেন। অনেক বিশ্ববিদ্যলয়ে শ্রেণিকক্ষসহ শিক্ষকদের অফিসকক্ষ দুপুরের পর তালাবন্ধ থাকে বলেঅভিযোগ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীসমাজ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে শিক্ষকদের সম্পর্কে একটিনেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। এছাড়া অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার উত্তরপত্র বিলম্বে মূল্যায়নকরার অভিযোগ রয়েছে এবং এর ফলে পরীক্ষার ফল নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে নাবলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কারো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ওই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে অধিকতর সময় ব্যয় করেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কত সময় বা কতটুকু দায়িত্ব বহন করতে পারেন, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। তাই শিক্ষকদের দায়িত্ব প্রতিপালন এবং সার্বিক আচরণের উপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রতি জোর দিয়েছে ইউজিসি।
প্রতিবেদনের আরো বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা প্রাথমিক বিষয় হলেও নানা কারণে গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য গবেষণাকে মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। পদোন্নতিতে গবেষণার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়াসহ নানা কারণে গবেষণা ও প্রকাশনার দিক অনেকটা নিষ্প্রভ থেকে যাচ্ছে।
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুলকালাম বাধিয়ে অশান্ত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস; বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্বিবিদ্যালয়। রাজনৈতিক বলির সেশনজটের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে চার বছরের সম্মান কোর্স শেষ করতে সময় লেগে যায় সাড়ে ছয় বছরেরও বেশি। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে রাজনীতি চলে এসব শিক্ষাঙ্গনে। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসন ও বিভাগের অবহেলোর কারণেই সেশন জট বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন ও সার্বিক আচরণের ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউজিসি।