পুরনো আবারও নতুন হয়ে উঠেছে। বার্ষিক গতির নিয়মে পৃথিবী নামক গ্রহটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে স্বস্থানে ফিরে এসেছে। কিন্তু ঘটনা কিছু বদলায়নি। গত বছরের এই ডিসেম্বর মাসেই জিহাদ নামে চার বছরের একটি শিশু দেশের ১৪ কোটি মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছিল। টেলিভিশন চ্যানেলের বদৌলতে আরো কয়েক কোটি মানুষ বিদেশে বসে জিহাদকে উদ্ধারের রুদ্ধশ্বাস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার পর কিছু যুবক অভিনব উপায়ে জিহাদকে উদ্ধার করেছে সত্যি, কিন্তু ততক্ষণে চৌদ্দ কোটি যোগ আরও কয়েক কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে দুরন্ত শিশু জিহাদের দেহ নীরব-নিথর হয়ে গেছে। এক বছর পর বঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করল আরেকটি জিহাদের ঘটনা। ওয়াশার ম্যানহোলে পড়ে মারা গেল নীরব নামে চঞ্চল আরো একটি শিশু। একই উপায়ে একই কায়দায় একইভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলায়। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে বেঁচে থাকাটাই যেন একটা দুর্ঘটনা। জন্মের আগে অপঘাতে মারা যাবে, বিধাতার কাছ থেকে এমন সার্টিফিকেট নিয়েই যেন বাংলাদেশ নামক দেশটিতে কাউকে জন্মাতে হয়। রোগ-বালাই বা পরিণত বয়সে মানুষের মৃত্যু হবে, এটা স্বাভাবিক। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, একেও আমরা স্বাভাবিক মনে করছি। এসব দেখে দেখে মৃত্যুর ঘটনা আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে বছরে যে পরিমাণ শিশুর মৃত্যু হয়, তা বাংলাদেশের যেকোনো ধরনের অপঘাতে মৃত্যুর ঘটনার চেয়ে বেশি। তারপরও এসব মৃত্যু নিয়ে আমাদের মনে খুব একটা দাগ কাটে না। এসব নিয়ে গণমাধ্যমেরও খুব একটা হইচই নেই। এতো এতো মৃত্যুর মাঝখানে এমন কিছু মৃত্যু আছে, যা মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। যেমন দিয়েছিল গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর জিহাদের মৃত্যুর ঘটনা। এবার মারা গেল নীরব। জিহাদের ঘটনা মানুষ হয়তো ভুলতে বসেছিল; কিন্তু নীরব মরে আবারও মানুষকে সরব করে দিয়ে গেল; অন্তত কিছু দিনের জন্য। রাজধানীর শ্যামপুরে স্যুয়ারেজ লাইনে মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে ঢাকনা না থাকা একটি ম্যানহোলে পড়ে যায় পাঁচ বছরের শিশু নীরব। হয়তো সে এ সময় সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিল। অবুঝ শিশুর জানার কথা না, আমাদের প্রশাসনের নির্মিত একটি নীরব ঘাতক গর্ত অপেক্ষা করছে তার জন্য। খেলতে খেলতেই সেই পড়ে গেল। কিংবা প্রত্যকক্ষদর্শী এক যুবকের ভাষ্য অনুযায়ী, তারই সমবয়সি আরেক অবুঝ শিশু তাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলে দিয়েছে। যে শিশুটি নীরবকে ধাক্কা দিয়েছে, সে এটাকে স্রেফ খেলাই ভেবেছে। ওটা ছিল আরেকটি অবুঝ শিশুর খেলা। অথচ নীরবকে মৃত্যুবরণ করতে হলো জনগণের টাকায় পোষা রাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ছেলেখেলার কারণে। একের পর এক দুর্ঘটনার পরও যদি তাদের টনক না নড়ে, সেটাকে ছেলেখেলা না বলে আর কী-ই বা বলা যায়। হা করা একটা দানবের মুখে নীরব পড়ে গেল। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন চোখ বুজে থাকে, একটি নির্জীব বস্তুও দানব হয়ে উঠতে পারে। শ্যামপুরের ঘটনা তা-ই প্রমাণ করে। জীবনটা যেহেতু রূপকথার গল্প না, তাই নীরব ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ এর স্বপ্নপুরিতে না গিয়ে এক মাইল দূরে বুড়িগঙ্গার পচা পানিতে অনন্তকালের জন্য নীরব হয়ে পড়ে রইল। প্রথমে স্থানীয়রা, পরে দমকল বাহিনীর কর্মীরা কয়েক ঘণ্টার চেষ্টার পর তাকে যখন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়, সে অবস্থায় শিশু নীরবের বেঁচে থাকার কথা না; বাঁচেওনি। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন, এখানে আনার অনেক্ষণ আগেই নীরব মারা গেছে। বাবা-মার একমাত্র সন্তান নীরব। তাকে হারিয়ে বাবা-মার যে আর্তনাৎ, তা হয়তো আমাদের খানিকটা ছুঁয়ে যায়, কিন্তু এই বেদনার সমান অংশীদারতো আমরা নই; হতেও পারবো না। আমরা কেবল ঘৃণা ছুড়ে দিতে পারি যারা এর জন্য দায়ী। এই যারা মানে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, তার লেজুর প্রশাসন, ওয়াশা, সিটি করপোরশেন, মেয়র, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইনপ্রণেতা। সেখানকার ম্যানহোলটি রাতারাতি ঢাকনাবিহীন হয়ে পড়েনি; অলৌকিক উপায়ে সেটি ওইদিন বিকেলেও এসে হাজির হয়নি। অনুমান করি সেটা অনেকদিন ধরেই সেখানে ছিল। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন গেছে বেশিদিন হয়নি। নিশ্চয়ই ওই জায়গাটি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মানুষের কাছে ভোট মাগতে গিয়েছিলেন। শ্যামপুরের নীরবের বাড়িতেও তারা গেছেন ধারণা করছি; তার বাবা-মার কাছে ভোট চেয়ে ছোট্ট নীরবকে আদর করে গাল টিপে দিয়েছেন, ফেরার পথে হয়তো ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলটি তাদের চোখে পড়ে থাকবে; কিংবা থাকবে না, কারণ তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি তাদের নজর দেওয়ার সময় কই। সিটি করপোরেশনের একজন নির্বাচিত মেয়র পেয়েছি; পেয়েছি অনেকগুলো কাউন্সিলর। শ্যামপুর এলাকার একজন কাউন্সিলর আছেন, তাও ধারণা করছি। নির্বাচনী বৈতরণি যেহেতু পার হয়ে গেছে, তাদের আর গরীব নোংরা এলাকায় যাওয়ার ফুরসত কই। একটি মরণফাঁদ যে সেখানে ঘাঁপটি মেরে রয়েছে, তা নিয়ে ভাবনারই বা সময় কই তাদের। পাঁচ বছর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবনে কাটিয়ে দিয়ে আবার নির্বাচন আসলে না হয় এসব নোংরা এলাকায় যাওয়া যাবে- এই হলো তাদের ভাবনা। বিগত পাঁচ বছর ঢাকা সিটি করপোরেশনে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিল না; একটি প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল কেবল লুটপাটের জন্য। জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় তারা দেখবে এ ভাবনা অমূলক। ম্যানহোলের ঢাকনা থাকলো কি থাকলো না, সেখানে কেউ পড়ে মারা গেলো কী গেল না, সে ভাবনা যেমন তাদের নয়, কোনো দুর্ঘটনার দায়ও তাদের নয়। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন দায়িত্ব অবহেলা করেন, তখন তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিশু নীরবের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আর এই হত্যার দায় অবশ্যই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। নীরবের দ্বিতীয় হত্যাকারীর নাম ঢাকা ওয়াশা। ঢাকা ওয়াশার একটি মনিটরিং সেল থাকার কথা। পানি সরবরাহ লাইনের কোথায় কী সমস্যা তা পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করে কোনো সমস্যা থাকলে, তার তড়িৎ সমাধান করা। শ্যামপুর একটি জনবহুল এলাকা। সেখানে অসংখ্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এসবকে কেন্দ্র করে প্রচুর জনবসতিও গড়ে উঠেছে। আর শ্যামপুরের পাশেই যেহেতু ওয়াশার প্রধান পানি সরবরাহ প্রকল্প, সুতরাং তার আশপাশে কী সমস্যা রয়েছে, সেসবের মনিটরিং করার দায়িত্ব ওয়াশার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। সেখানে এতো বড় একটি গর্ত- এর আশপাশ দিয়ে মানুষ চলাচল করে, শিশুরা খেলতে যায়। একটা বড় কোনো দুর্ঘটনা যে ঘটতে পারে তা তাদের ভাবনায় থাকবে না? না, থাকবে না। কারণ ওই এলাকায় যাদের বাস তাদের অধিকাংশই গরীব। সেটা কোনো অভিজাত এলাকা নয়। কোনো বড় লোকের ছেলে-মেয়েরা সেখানে খেলাধুলা করে না। গরীব বস্তিবাসী শিশুরাই সেখানে খেলতে যায়। তারা মরল কী বাঁচল ও নিয়ে মাথা ঘামানো ওয়াশার কর্মকর্তার দরকার কী। রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিকে কীভাবে ধ্বংস করা যায়; বহুজাতিক পানি কোম্পানিগুলোকে কীভাবে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া যায়, তা নিয়েই ওয়াশার কর্মকর্তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। আর এসবের মধ্যে দিয়ে তাদের আগামী কয়েক প্রজন্মের নিশ্চিত নিরাপদ জীবন। রাষ্ট্র বলে যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে, সংবিধান বলে যদি কিছু থেকে থাকে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায় যদি সরকার নিয়ে থাকে, তাহলে ওয়াশার ওই কর্মকর্তাদের শিশু নীরব হত্যার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে। কেবল একটি তদন্ত কমিটি, কিছু কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পরিবার নিয়ে দেশে-বিদেশে বেরানোর সুযোগ দিয়ে সরকারের দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না; নির্বাহী এই প্রতিষ্ঠানটি যদি সত্যিই জনগণের সেবক হয়, তবে দায়িত্ব অবহেলার দায়ে ওয়াশার কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গত বছর জিহাদের মৃত্যুর ঘটনার পর প্রশাসন কিছু লোক দেখানো তৎপড়তা শুরু করে। কিন্তু ওয়াশা বা রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তাকে বরখাস্ত বা তারা কোনো প্রকার শাস্তি ভোগ করেছে কিনা তার খবর আমাদের কাছে নেই। নীরবের ঘটনার পরও প্রশাসন কিছু তৎপরতা দেখাবে। একটি লোক দেখানো তদন্ত কমিটি হবে। কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। কয়েকদিন গণমাধ্যম উচ্চবাচ্য করবে। এক সময় সবাই নীরবের কথা ভুলে যাবে। প্রশাসন সাপের মতো আবারও গভীর শীতনিদ্রায় যাবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন করে আরেকটি জিহাদের, আরেকটি নীরবের ঘটনার জন্ম দিয়ে যাবে একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ। নতুন ঘটনায় প্রশাসন খোলস ছেড়ে, চোখ ডলে আবারো নিদ্রা ভাঙবে। এভাবে আবর্তন, প্রত্যাবর্তনে জিহাদ-নীরবরা ঘটনার জন্ম দিয়েই যাবে। একই দৃশ্যে আমাদের চোখ আটকে থাকবে। জিহাদ-নীরবরা কটাক্ষ নিয়ে মুচকি হাসবে। আর আমাদের অভিভাবকরা উন্নয়নের ফিরিস্তি সম্বলিত চোতা ধরিয়ে দিবেন। এটাই যেন আমাদের নিয়তি।